আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি অনেক আগেই। আমি মেনেই নিয়েছি যে জগতের সব থেকে কপাল খারাপ আসলে আমারই হবে। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এই ব্যাপারটা আমার সাথে হয়ে আসছে। তাই এখন আর কিছু মনে হয় না। আমি মেনেই নিয়েছি যে আমার সাথে সব সময় খারাপ কিছুই হবে। কিন্তু তাই বলে এতো বড় বিপদে যে আমি পড়ব সেটা আমি ভাবি নি। অফিস থেকে সোজা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে যদি আমি কালকের ভেতরে হিসাবটা না মেলাতে পারি তাহলে চাকরি তো যাবেই সেই সাথে আমাকে তারা পুলিশে দিবে।
আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারলাম না। কীভাবে যে হিসেবে এতো বড় গড়মিল হল সেটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। আমার কপাল খারাপ আমি জানি তবে কাজকর্মে আমি বেশ ভালই দক্ষ। টাকার পরিমানটাও কম না। প্রায় ছয় লাখ টাকার ব্যাপার। এতো টাকা আমি এখন পাবো কোথায়?
আজকে বেশ রাত পর্যন্ত আমি অফিসে বসে বসে সেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছিলাম তবে কোনো কিছুতেই কিছু বের করতে পারি নি। শেষে বাধ্য হয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। আজকে কিছু ভাল লাগছিল না। মনের ভেতরে একটা অস্বস্তির অনুভূতি হচ্ছে। অফিসের গেট দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসতে দেখতে পেলাম যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। কিছু সময় গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। একবার মনে হল যে একটা সিএনজি বা রিক্সা নিই। কিন্তু তারপর সেই পরিকল্পনা বাদ দিলাম। আমার বাসা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলে আধা ঘণ্টার ভেতরে চলে যাব। আর কিছু না ভেবেই আমি বৃষ্টির ভেতরে নেমে পড়লাম। একেবারে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে না। তাই শরীর একেবারে ভিজে গেল না। আমি সেই টিপটিপ বৃষ্টির ভেতরেই হাঁটতে লাগলাম। প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। গায়ে বৃষ্টি পড়ছে, খুব একটা খারাপ লাগছে না। শুধু অফিসের এই ঝামেলাটা না থাকলে এই বৃষ্টিটা আমার বেশ ভাল লাগত। ছাত্র থাকা অবস্থায় যখন টিউশনি থেকে রাতে হলে ফিরতাম তখন বৃষ্টি হলে প্রায়ই আমি ভিজতাম। এই জন্য মানিব্যাগের ভেতরে সব সময় আমি একটা পাতলা পলিথিন রেখে দিতাম যাতে বৃষ্টির পরিমান বাড়লে আমি মোবাইল আর মানিব্যাগ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। তবে আজকের বৃষ্টির বেগ খুব বেশি ছিল না।
আমি আপন মনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। শহরের প্রধান সড়কে গাড়ির পরিমান বেশি হলেও এই ভেতরের রাস্তাগুলোতে গাড়ি বা রিক্সার পরিমান একেবারেই নেই। বৃষ্টির কারণে মানুষজন সব এখন বাসায় ঢুকে গেছে। আজকের রাতে আর কেউ বাসার বাইরে বের হবে না।
নিজের এলাকায় এসে প্রথমে রাতের খাবার কিনে নিলাম। অন্যান্য দিনে আমি সাধারণত হোটেল থেকে খাবার খেয়েই তারপর উঠি তবে আজকে জামা কাপড় অনেকটাই ভেজা। এই ভেজা কাপড়ে শান্তিমতো খাওয়া যাবে না। খাবারের প্যাকেট নিয়ে বাসার গলির কাছে আসতেই আমি কালো বেড়ালটাকে দেখতে পেলাম। গলির ঠিক মুখের একটা বড় গাছ রয়েছে। সেই গাছের গোড়ায় ভিজে জবজবে হয়ে বসে আছে। বৃষ্টির পানিতে বেচারার অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে গেছে। আমি যদিও ঠিক ক্যাট পার্সন নই তবুও কেন জানি এই ছোট প্রাণীটার অবস্থা দেখে মায়া লাগল। আমি পরিষ্কারই বুঝতে পারি যে গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে হয়তো কারো মনে এই বেড়ালটার জন্য সামান্যমাত্র মায়া জন্মায় নি। অন্য রংয়ের হলে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ এটাকে নিয়ে যেত। অন্তত ছবি তুলে ফেসবুকে অ্যানিমেল শেল্টার গ্রুপে পোস্ট করত।
আমি একটু দাঁড়িয়ে বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার কাছে কেন এই বেড়ালটার ভাগ্য আর আমার ভাগ্য একই মনে হল। আমার দিকে কেমন করুণ চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে। আমার মনের ভেতরে আপনা আপনিই একটা অনুভূতি হল। আমি খালি থাকা হাত দিয়ে বেড়াল তুলে নিলাম। বেড়ালটা মোটেই পালানোর চেষ্টা করল না। এমনকি একটু ডাকলো না। যেন সেটা জানতোই যে আমি তাকে হাত দিয়ে তুলে নিব।
বাসায় যখন ঢুকলাম তখন মনে হল যে কাজটা মোটেই ঠিক হল না। আমি সারাদিন অফিসে থাকি, এই বেড়ালটাকে কে দেখাশোনা করবে? ঘরে থাকলে নিশ্চয়ই সারাদিন ম্যাও ম্যাও করবে। তবে এখন এই বৃষ্টির ভেতরে এটাকে কোনোভাবেই আর বাইরে ফেলে আসা যাবে না। কাল বৃষ্টি কমলে তারপর বাইরে রেখে আসা যাবে।
আমি নিজে গোসলে যাওয়ার আগে বেড়ালটাকে একটা ছোট গোসল দিলাম। বাইরে থাকা সত্ত্বেও দেখলাম বেড়ালটা বেশ পরিষ্কার রয়েছে। অবশ্য বেড়াল এমনিতেই পরিষ্কারই থাকে সব সময়। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হল না। বেড়ালটা গোসল করিয়ে তারপর শরীরটা মুছে দিলাম। তারপর নিজে গেলাম গোসলে।
যখন গোসল শেষ করে ফিরে এলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম বেড়ালটা আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু সময় আমি বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন জানি বেড়ালটাকে এভাবে আরামে ঘুমাতে দেখে ভাল লাগল। অনেকটা সময় আমি সেদিকেই তাকিয়ে রইলাম। আমার মাথা থেকে অন্য সব দুশ্চিন্তা একেবারে চলে গেল।
খাওয়ার সময়েও আমি বেড়ালটার ঘুম ভাঙ্গালাম না। সাথে করে নিয়ে আসা খাবারের কিছু অংশ বেড়ালটার জন্য রেখে বাকিটা দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। আজকে আর কিছুই করতে ইচ্ছে করছিল না। একেবারে সোজা আবার বিছানায় চলে এলাম। বেড়ালটা তখনও ঘুমিয়েই আছে। আমি সাবধানে বিছানায় উঠে এলাম। বেড়ালের ঘুম যেন না ভাঙ্গে এমন ভাবেই আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
অশ্চর্যজনক ভাবে আমার রাতে ভাল ঘুম হল। তবে আমার ঘুম খুব গাঢ় নয়। ঘুমের মাঝেই বেশ কয়েকবার টের পেলাম যে বেড়ালটা আমার শরীর ঘেঁষে এসেছে। একবার আমার কাছে উঠে চলে গেল, সেটাও টের পেলাম। আবার ফিরে এল একটু পরে তারপর আবারও আমার শরীর ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গল তখন তাকিয়ে দেখি বেড়ালটা তখনও ঘুমাচ্ছে। আমি খাবার ঘরে এসে দেখলাম যে বেড়ালের জন্য যে খাবার আমি রেখেছিলাম সেটা আর নেই। নিশ্চয়ই বেড়ালটাই খেয়েছে। রাতে যখন ঘুম থেকে উঠেছিল তখনই সম্ভবত এখানে এসেছে খেয়েছে।
অফিসে যাওয়ার সময়ে দেখলাম বেড়ালের ঘুম ভেঙ্গেছে। সে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমাকে দেখছে। আমি বেড়ালটা নিয়ে একটু চিন্তিত হলাম। কী করব ঠিক বুঝতে পারলাম না। এটাকে ঘরের ভেতরে বন্দী করে রেখে যাওয়া মোটেই ভাল কাজ হবে না। তবে কেন জানি বের করে দিতেও ইচ্ছে হল না।
আমার বাসাটা ছয় তলার ছাদের উপরে। মালিক ৫ তলা পর্যন্ত করে ছয় তলার এই দুইটা রুম শেষ করেছে তারপর আর কেন জানি কাজ শেষ করে নি। কেন করে নি সেটা আমি জানি না।
আমি আমার শোবার ঘরের একটা জানালা খোলা রাখলাম। তাহলে বেড়ালটা যদি চায় তবে জানালা দিয়ে খোলা ছাদে চলে যেতে পারবে, সিঁড়িঘর খোলা থাকে, চাইলে সিঁড়ি দিয়ে নিচেও নেমে যেতে পারবে।
ঘরে কফি বানানোর জন্য গুড়ো দুধ ছিল। সেটা দিয়ে বাটিতে দুধ বানিয়ে বেড়ালটার সামনে দিলাম। তবে বেড়ালটা বিছানা থেকে একটুও নড়ল না। এক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অবশ্য আর বেশি অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। বুঝবে না জেনেও বেড়ালটাকে হাতের ইশারায় প্রথমে দুধের বাটিটা দেখালাম, তারপর খোলা জানালার দিকে নির্দেশ করলাম। আমার মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিল। আমার কেন জানি মনে হল যে বেড়ালটা আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে।
দুই
অফিসে এসে আমার ভেতরে সেই দুশ্চিন্তা আবার ভর করল। আবারও কিছু সময় আমি হিসাবটা মেলার চেষ্টা করলাম তবে কোনো লাভই হল না। ছয় লাখ টাকার কোনো হিসাব নেই। একটা সময়ে আমি খান্ত দিলাম হিসাব মিলানোর। মনে মনে সব থেকে খারাপ ঘটনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। একটু পরেই হয়তো ম্যানেজারের ঘরে আমার ডাক পড়বে। তারপর আমাকে টার্মিনেশন লেটার দেওয়া হবে। তারপরই সম্ভবত পুলিশ ডাক দেওয়া হবে। পুলিশ না ডাকলেও আমাকে সম্ভবত একটা সময় দেওয়া হবে এই টাকা ফেরত দেওয়ার। তারপর হয়তো পুলিশ ধরবে। তবে আজকেই যে আমার চাকরি যাবে সেটা নিশ্চিত।
আরও ঘণ্টা খানেক পরে ম্যানেজারের কেবিনে আমার ডাক পড়ল। আমি যখন করিডোর দিয়ে তার কেবিনের দিকে যাচ্ছিলাম তখন চারপাশটা আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। মিমির ডেস্কের দিকে তাকিয়ে একটু মন খারাপ হয়ে উঠল। আজকের পরে সম্ভবত মেয়েটার সাথে আর কোনো দিন দেখা হবে না। সম্ভবত বলছি কেন আজকের পরে ওর সাথে আর কোনো দিন দেখা হবে না। মিমি কোনো দিন আমার নামই জানবে না, আমাকে চেনা তো অনেক পরের ব্যাপার।
কেবিনের দরজায় নক দিতেই ভেতরে কাম ইন শুনতে পেলাম। আমি একটু কাঁপা কাঁপা পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই আমার পা যেন চলছিল না।
-বসুন রূপক সাহেব।
-স্যার আমি সত্যিই টাকাটা নেই নি। আমি বুঝতেই পারছি না টাকাটা কোথায় গেল!
ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমি জানি টাকাটা আপনি নেন নি। টাকার খোঁজ পাওয়া গেছে। আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে। এই বিলটা আসলে গতমাসের শেষের দিকে এসেছিল। টাকা ঐ মাসে পেলেও কাগজপত্র এসেছে এই মাসে। ব্যাকডেট দিতে আমার মনে ছিল না। আমি খুবই দুঃখিত রূপক সাহেব। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
এই বলে ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে একটা খাম এগিয়ে দিলেন। যদি একটু আগের কথাগুলো তিনি না বলে আমার দিকে এই খাম এগিয়ে দিতেন তাহলে আমি নিশ্চয়ই ধরে নিতাম যে এই খামের ভেতরেই আমার টার্মিনেশন লেটার রয়েছে। কিন্তু এখন আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে খামের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়। ম্যানেজার সাহেব আমার মনের ভাব বুঝতে পারলেন সম্ভবত। তাই তিনি একটু হেসে বললেন, খামটা খুলেই দেখুন।
আমি খাম খুললাম। তারপরেই একটা তীব্র বিস্ময় অনুভব করলাম। আমাকে প্রমোশন দিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি ম্যানেজার করা হয়েছে। কদিন থেকেই অফিসে কানাঘুষা চলছিল যে এই পদে নতুন লোক নেওয়া হবে। কিন্তু সেই পদটাই যে আমাকে দেওয়া হবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনি আমাদের অফিসে বেশ কিছু দিন ধরেই কাজ করছেন। আপনার কাজকর্ম বেশ ভাল। আপনি পাংচুয়াল। আমার মনে হয় যে আপনি এই পোস্টের সব থেকে বড় দাবিদার।
আমার কাছে আসলে সব কিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। এমন সৌভাগ্য আমার এর আগে কোনো দিন হয় নি।
আমি খামটা নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম। নিজের ডেস্কেই বসে রইলাম বেশ কিছুটা সময়। আজকে কেন জানি আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আজকে আমি মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াই।
দেখলাম কিছু সময়ের ভেতরেই অফিসের অনেকের কাছে আমার প্রমোশনের খবর পৌঁছে গেল আর জীবনের প্রথমবারের মতো একে একে আমার অফিসের লোকজন আমার সামনে এসে হাজির হতে লাগল আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। এমনকি মিমি নিজেও এল এক সময়ে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, রূপক সাহেব ট্রিট কিন্তু দিতেই হবে। আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হল!
অফিসের পরে সত্যিই আমি সবাইকে ট্রিট দিতে নিয়ে গেলাম। আমার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এই মানুষগুলো আমার কাছে গতকালও অপরিচিতই ছিল। কিন্তু আজকে আমার যেন মনে হচ্ছে এরা আমার কতই না কাছের মানুষ। কালকে আমি যখন অফিস থেকে বের হচ্ছিলাম তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমার আর চাকরি করা হবে না আর আজকে আমি প্রমোশন পেয়ে গেছি! ভাগ্যদেবী আমার প্রতি এমন সুপ্রসন্ন হলেন কেন হঠাৎ?
রাতে বাসায় ফিরতে একটু দেরি হল বলা চলে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালতেই আমার চোখ পড়ল গতকালকের কালো বেড়ালটার উপরে। আমার ডাইনিং টেবিলের উপরে চুপচাপ বসে আছে। আমার দিকে মুখ করা, একেবারে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হল যে বেড়ালটা ঠিক জানতো আমি এই সময়েই বাসায় আসব তাই আমার জন্য এখানে অপেক্ষা করছে?
অবশ্য বেড়ালদের শ্রবণশক্তি ভাল। আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি সেটা সে শুনতেই পারে! কিন্তু এমন ভাবে তাকিয়ে থাকাটা কি স্বাভাবিক?
আমার কেন জানি মনে হল যে এই কালো বেড়ালটাই মূলত আমার সৌভাগ্যের জন্য দায়ী! কেন এমনটা মনে হল সেটার পেছনে আমার কোনো ব্যাখ্যা নেই। যদিও কালো বেড়ালকে সব সময় কুফা মনে করে হয় তারপর এই কালো বেড়ালকে আমার লাকি মনে হল। আমার জীবন তো আগে থেকেই কুফায় ভর্তি তাই কুফা কুফায় কাটাকাটি হয়ে আমার জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে।
আমি বেড়ালটাকে কোলে তুলে নিলাম। বেশ কিছুটা সময় আদর করলাম। তারপর গতদিনের মতো করে বেড়ালের জন্য দুধ তৈরি করে দিয়ে গোসলে করতে গেলাম। যথারীতি যখন ফিরে এলাম দেখি সে গতদিনের মতো করে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিলের দুধ সে ছুঁয়েও দেখে নি। হয়তো খিদে নেই। জানালা খোলা ছিল। তাই নিশ্চয়ই বলা যায় যে সারাদিন সে বাসায় থাকে নি। নিজের মতো করে ঘুরে বেড়িয়েছে। কালকে ফেরার পথে বেড়ালের জন্য ভাল মানের খাবার নিয়ে আসব বলে ঠিক করলাম। বেড়ালকে আমি এবার নিজের কাছে রেখেই পুষব ঠিক করলাম।
গতদিনের মতো একই ভাবে আমি রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম বেড়ালটার পাশে। সকালে বেশ হইচইয়ের আওয়াজ শুনেই ঘুম ভাঙ্গল আমার। কিছু সময় বিছানায় শুয়েই আওয়াজ শুনে বোঝার চেষ্টা করলাম। আওয়াজ আসছে নিচ থেকে। সেখানে অনেক মানুষ কথা বলছে, কোনো কিছু হয়েছে। আমি শব্দগুলো একটু মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। তারপরেই বুঝতে পারলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের কেউ মারা গেছে কাল রাতে। আমি অবশ্য খুব বেশি চিন্তা করলাম না। এই বিল্ডিংয়ে আমি কাউকে চিনি বলে মনে নেই। তাই অন্যের শোকে নিজেকে দুঃখিত করার কোনো মানে নেই।
সকালে উঠে অফিস যাওয়ার সময়ে আমি বেড়ালটাকে খুঁজলাম তবে কোথাও দেখতে পেলাম না। বেড়ালটা নিশ্চয়ই বাইরে গেছে। তবে টেবিলের উপরের খাবার সে খায় নি। দুধ যেমন রেখেছিলাম তেমনই রয়ে গেছে। আমি সেটা ফেলে দিয়ে আবারও নতুন করে দুধ রেখে অফিসে চলে এলাম। আজকে অফিস থেকে ফিরে আসার সময় ক্যাটফুড নিয়ে আসতে হবে।
এরপর আমার জীবনে একটা পর একটা সুসংবাদ আসতে লাগল। চাকরি বন্ধু বান্ধব ফ্যামিলি সবার দিক থেকে আমি যেন সবার সামনে চলে আসছিলাম। কিন্তু সেই একই সাথে আমার মনের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম অস্বস্তি দানা বাঁধছিল। এটা কেন আসছিল সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। আমার সাথে খারাপ কিছু হচ্ছিল না। বরং সব কিছু ভাল হচ্ছিল। একটু যেন বেশিই ভাল হচ্ছিল। এটাই কেন জানি আমার ভাল লাগছিল না। আসলে যে মানুষের সাথে সারা জীবন কেবল খারাপই হয়েছে তার সাথে যখন হঠাৎ করেই সব ভাল ভাল হতে থাকে তখন তো একটু অস্বস্তি হবেই। ব্যাপারটা আমি টের পেলাম আরও মাস দুয়েক পরে। আমি কালো বেড়ালটার নাম রেখেছি চিনি। ও আসার পর থেকে আমার জীবনে মিষ্টির একটা প্রলেপ পড়েছে তাই এই নাম। চিনির ভেতরে যে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে সেটা আমি শুরু থেকেই খেয়াল করেছি। সে অন্য বেড়ালের মতো মিউমিউ করে না। একবার আমি ওকে পশু চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলাম। তারা সব পরীক্ষা করে জানাল যে কোনো সমস্যা নেই তবে কেন যে বেড়ালটা ডাকে না সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
এদিকে মিমির সাথে আমার সম্পর্ক ভালর দিকে যাওয়া শুরু করেছে। আমি কোনোদিন যা ভাবি নি তাই আসলে হচ্ছে। মিমি সম্ভবত আমাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। প্রমোশনের পর থেকেই মিমির সাথে আমার কাজের পরিমানটা বেড়েছে। আমাদের দুজনকে প্রায়ই সাইট ভিজিটে যেতে হচ্ছে। যাওয়া আসার এই সময়টা আমাদের সময় বেশ ভাল কাটছে। আমি বুঝতে পারছি কত দ্রুত আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে চলছে। এই সম্পর্কে উন্নয়নের কারণেই বলা চলে এই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা আমাদের সামনে এল।
সেদিন সাইট ভিজিট শেষ করে মিমিই বলল যে অফিসে আজকে আর গিয়ে কাজ নেই। আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। অবশ্য অফিস ছুটির সময়ও হয়ে গিয়েছিল। আমাদের রাস্তাতেই সময়টা কেটে যাবে। তাই ঠিক হল রিপোর্ট কাল সকালে দিলেই চলবে, আমরা বরং একটা মুভি দেখে আসি।
মুভি দেখার পরে রাতের ডিনারও এক সাথে করলাম। তারপরই ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলাম। ওকে যখন দরজার কাছে রেখে চলে আসব তখন আমাকে অবাক করে দিয়েই মিমি আমার ঠোঁটে চুমু খেল। আমি একেবারে জমে গিয়েছিলাম। মনের ভেতরে একটা তীব্র আনন্দ এসে জড়ো হল। ইচ্ছে হচ্ছে ওকে জড়িয়ে ধরি তবে সেটা করার উপায় ছিল না। মিমি লজ্জা মিশ্রিত চোখ নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে গেল।
আমি মনের আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। বাসার কাছে এসে আজও বেশ জটলা দেখতে পেলাম। দারোয়ানের কাছে জিজ্ঞেস করতেই জানালো যে পাশের বাসায় এক লোক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সেই লাশ নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকা শহরে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। অবশ্য এখানে আমাদের কীই বা করার আছে। এই দেশের নাগরিকদের এইভাবেই মরতে হবে একদিন। আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। যথারীতি চিনি আমার টেবিলের উপরে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি অফিসের ব্যাগটা রেখে ওকে কোলে নিয়ে একটু আদর করলাম। তারপর নিজে গোসলে চলে গেলাম। আজকে আমার মনটা বেশ ফুরফুরে!
পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখি মিমি আমার দিকে একটু পরপরই তাকাচ্ছে। আর মিটিমিটি হাসছে। আমিও মিটিমিটি হাসছি। তবে লাঞ্চ আওয়ারে সে আমাকে যে বলল তাতে আমার চোখ কপালে উঠল একেবারে। গতকাল যে সে আমাকে চুমু খেয়েছে সেটা তার ছোট মামা দেখে ফেলেছে। তার ছোট মামা তাদের বিল্ডিংয়েই ভাড়া থাকে। একেবারে উপরের তলায়। সে বারান্দায় বসে ছিল তখন আমাদের দেখেছে। তবে মিমি আমাকে আশ্বস্ত করে বলল যে চিন্তার কোনো কারণ নেই। মামার সাথে সে খুব ফ্রি। মামা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। এবং সেটা আজকেই।
অফিস শেষ করে মিমি আর আমি ওর মামার সাথেই দেখা করতে গেলাম। মিমিই জানালো যে ওর মামা একটু আধ্যাত্মিক টাইপের মানুষ। জ্বিন ভূত তাড়ায়। ভূতের ওঝা এবং তার ক্লায়েন্টের সংখ্যা নাকি অনেক। মতিঝিলে তার অফিসও আছে। আমি চোখ কপালে তুললাম। এই যুগে এসেও মানুষ এসব কাজে বিশ্বাস রাখে!
তবে মিমির মামার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে আমার চিন্তাভাবনা বদলে গেল। তাকে দেখে আর যাই মনে হোক আমার কাছে জোচ্চোর মনে হল না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময়। তারপর বললেন, তোমার উপরে একটা ভয়ানক বিপদ এসে জড় হয়েছে। তোমার সাথে কিংবা আশেপাশে যারা আছে তাদের জন্য ব্যাপারটা মোটেই ভাল ব্যাপার না।
আমি বললাম, মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময় তারপর বললেন, কদিন ধরে তোমার আশেপাশে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, তাই না?
-মানে? আমি ঠিক বুঝলাম না।
-মানে হচ্ছে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যায় কিন্তু তুমি তোমার আশেপাশে কয়টা মৃত্যুর সংবাদ শোনো? নিশ্চয়ই তোমার আশেপাশে প্রতিদিন মানুষ মারা যায় না? এমনকি কোভিডের সময়েও প্রতিদিন মানুষ মারা গেছে কিন্তু তোমার আশেপাশে কি প্রতিদিন মৃত্যু হয়েছে?
আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম। সত্যিই তো, কোভিডের কয়েকমাসের সময়ে আমার এলাকাতে সব মিলিয়ে ২০/২২ জন মারা গিয়েছিল। তাও তো প্রতিদিন না। এমনি স্বাভাবিক সময়ে তো কালে ভাদ্রে শোনা যায় যে কেউ মারা গেছে। কিন্তু গত কিছু দিন থেকেই আমার এলাকাতে আসলেই মৃত্যুর সংবাদ একটু যেন বেশি বেশি আসছে।
আমার চেহারার ভাব দেখেই মিমির মামা বুঝে গেলেন যে তার অনুমান মিথ্যা নয়। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সামনের দিনে এই পরিমানটা আরও বেশি হবে।
-বেশি হবে বলতে?
-এখন কয়েকদিন পরপর শুনছো তখন প্রতিদিন শুনবে তারপর দিনে কয়েকবার করে শুনবে?
মিমির দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ শুকিয়ে গেছে। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম মিমির মামার দিকে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিমির মামা বললেন, গ্রিক পুরাণে এই দেবীর নাম পাবে। ম্যালেফিকা। মানুষকে সৌভাগ্য দেয় ঠিকই কিন্তু তার বদলে কেড়ে নেয় অনেক কিছু। প্রথমে পরিচিত মানুষ এরপর আত্মীয় স্বজন এরপর বাবা মা ভাই বোন স্ত্রী এবং সবার শেষে তুমি! যদি এখনই না থামাও তবে এই হবে তোমার পরিণতি। বুঝতে পেরেছো কি?
আমি বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ……
-শোন, তোমার এই সব কথা নাও বিশ্বাস হতে পারে তবে আমি তোমার মাথার উপরে কালো সেই দেবীর ছায়াকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি কী করবে সেটা আমি জানি না। আমি তোমাকে তোমার পরিণতির কথা জানিয়ে দিলাম। আর তোমার সাথে আমি আমার ভাগ্নিকে কোনোভাবেই মিশতে দিবো না। তোমার আশেপাশে থাকা মানেই বিপদ।
মিমির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে খানিকটা ভীত চোখেই তাকিয়ে রয়েছে। আমার সাথে থাকলেই যে মারা যাবে এই কথা সে বিশ্বাস করে নিয়েছে। এখন আমি কী করবো?
চলবে…..