মিমির মামা আমাকে যা করতে বলেছিলেন আমি ঠিক সেই মোতাবেকই কাজ করেছিলাম। তারপরেও মিমি আমার থেকে দূরে চলে গেল কেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। অবশ্য আমি মিমির জায়গাতে থাকলে আমিও কি নিজের জীবন বাঁচাতে দূরে চলে যেতাম না?
মিমির মামাকে আমি সব খুলে বলেছিলাম। কিভাবে আমার সৌভাগ্য পেলাম। কিভাবে আমার আগের দুর্ভাগ্য সব সৌভাগ্যে পরিণত হল এবং সবার শেষে আমি চিনি মানে আমার কালো বেড়ালের কথা বললাম। মিমির মামা তখন আমাকে জানালো সেই কালো বেড়ালরূপেই ম্যালেফিকা আমার কাছে এসেছে। আমি তাকে কাছে টেনে নিয়েছি তখন থেকেই সে অন্যের জীবন চুরি করে আমাকে সৌভাগ্য দিচ্ছে। আমি তাকে যত বেশি আদর করছি, তাকে আমি যত আমার সৌভাগ্যের কারণ মনে করছি সে তত বেশি শক্তি পাচ্ছে। আমি যদি তাকে আমার সৌভাগ্যের কারণ মনে করা বন্ধ করি তবেই সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তবে এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আমি যদি তাকে আমার সৌভাগ্যের কারণ মনে করা বন্ধ করি, তাকে আমার বাসা থেকে বের করে দিই তবে তার দেওয়া সৌভাগ্যগুলো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।
আমি মিমির মামাকে জানালাম যে অবশ্যই আমি এটাই চাই যে আমার কারণে অন্যের কোনো ক্ষতি যাতে না হয়। আমি নিজের সৌভাগ্য চাই তবে তার মানে এই না যে আমি অন্যের জীবনের বিনিময়ে সেটা চাই।
মিমির মামা তারপর কী যেন মন্ত্র পড়ে আমাকে ফুঁ দিল। তারপর একটা বোতল ধরিয়ে দিল আমাকে। বলল যে আমি যেন এই বোতলের ভেতরের পানীয়টা যেন আমি আমার বাসার চারিদিকে ছড়িয়ে দেই। তাহলেই সেই বিড়ালটা আমার বাসায় আর আসবে না। অর্থাৎ ম্যালেফিকা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তবে সব থেকে জরুরি ব্যাপার হচ্ছে আমাকে মন থেকেই এটা চাইতে হবে যে আমি তাকে আর চাই না। আমি তাকে আর আমার সৌভাগ্যের কারণ মনে করি না। এইটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।
আমি যখন মিমির মামার বাসা থেকে বের হয়ে এলাম মিমি আমার দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে ছিল। সত্যি বলতে কি তার চোখে সেই ভালোবাসার আভা আমি দেখেছিলাম সেটার ছিটেফোঁটাও দেখতে পেলাম না। বরং সেখানে একটা ভয়ের আভা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের মাঝে কোন কথা হল না। মিমি কেবল আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি কিছু একটা বলতে চাইছিলাম তবে কেন জানি বলতে পারলাম না। আমার সাথে মিমির এই পরিচয় হওয়ার কারণও তো সেই অন্য কারো মৃত্যু। কেউ মরেছে বলেই তার ভাগ্যটা এসে আমার উপরে ভর করেছে।
রাতে বাসায় এসে দরজার সামনে দাঁড়ালাম। আমি জানি যে দরজা খুললেই আমি চিনিকে দেখতে পাব। আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি পকেট থেকে সেই পানির বোতলটা বের করলাম। মুখটা খুলে ছিটিয়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে একটু থামলাম। মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত চিন্তা এসে জড় হল আমার। এটা যদি আমি ছিটিয়ে দেই তাহলে চিনি চলে যাবে, তার মানে আমার সকল সৌভাগ্যও ছেড়ে যাবে আমাকে। আমি ঠিক আবারও আগের মত হয়ে যাব। আগের সবার চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে যাব। কেউ আমার অস্তিত্বই মনে রাখবে না। একবার মনেও হল যে যে মরে মরুক আমার তাতে কী? আমার কথা কে চিন্তা করেছে কোন দিন? তবে জোর করেই চিন্তাটা আমি মাথা থেকে বের করে দিলাম। আমার সাথে যতই খারাপ কিছু হোক না কেন আমি কোন ভাবেই চাই না যে অন্যের ভাগ্য চুরি করে আমি নিজের ভাগ্য গড়ি।
আমি বোতলের পানিটা দরজার কাছে ছিটিয়ে দিলাম। তখন টের পেলাম ঘরের ভেতরে একটা কিছু যেন দ্রুত ছুটে পালিয়ে গেল। সেই পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজ আমি বাইরে থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
মনে মনে খুব করে চাচ্ছিলাম যেন আমি যখন দরজা খুলব তখন যেন আমি চিনিকে দেখতে পাই। মিমির মামা আমাকে যা যা বলেছেন সব যেন মিথ্যা হয়। আমি যেন চিনিকে দেখতেই পাই। কিন্তু দরজা খুলে চিনিকে দেখতে পেলাম না। পুরো ঘর আমি খুঁজে দেখলাম। বেড়ালটা কোথাও নেই। আমি পুরো বাসায় চারিদিকে সেই পানিটা ছিটিয়ে দিলাম। তারপর যথারীতি গোসলে ঢুকে গেলাম।
রাতে কেন জানি আমার ঘুম এল না। মনের ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা ঠিকই টের পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল যে এই কয়মাসে যা যা অর্জিত হয়েছে সব কি তাহলে সত্যিই চলে যাবে?
উত্তরটা পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। পরের দিন অফিসে এসেই জানতে পারলাম যে মিমি রেজিগনেশন দিয়ে চলে গেছে। আমি একটু অবাকই হলাম। তবে মিমির এই রেজিগনেশন দিয়ে চলে যাওয়ার কারণটা আমি নিশ্চিত ভাবেই জানি। আমি কয়েকবার মিমিকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। প্রথমে রিং হচ্ছিল তবে দুইবার বাজার পরেই সেটা কেটে দিল সে। এরপর যখন আবার ফোন করার চেষ্টা করলাম তখন দেখতে পেলাম ফোনটা বন্ধ। তার মানে হচ্ছে সে আমার সাথে আর কথা বলতে চায় না।
এরপর একের পর এক খারাপ সংবাদ আসতেই লাগল। প্রোমোশনের পরে আমি ঠিক যে যে কাজে হাত দিয়েছিলাম সব ‘ব্যাকফায়ার’ করতে লাগল। একটা পর্যায়ে আমার চাকরিটা চলেই গেল। আমার নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণেই কোম্পানির ক্ষতি হয়েছে। কাউকে না কাউকে তো দায় নিতেই হবে। এবং আগের মত সেই বলির পাঠা হলাম আমি নিজে।
সত্যি বলতে কি পরের দুই মাসের ভেতরে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। কিছু শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলাম সেগুলো একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। এমন কি যে ব্যাংকে টাকা রেখেছিলাম সেই ব্যাংক পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে গেল। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা যে বাড়িভাড়া দেওয়ার মত টাকা ছিল না। আমি কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এর আগেও আমার ভাগ্য খারাপই ছিল কিন্তু এখন যে অবস্থা যে আমাকে যেন না খেয়ে থাকতে হবে কদিন পরে। আমি যখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই আমি আবারও ম্যালেফিকার দেখা পেলাম। তবে এবার সে আমার কাছে বিড়ালের বেশে এল না। এবার সে এল তার আসল রূপে!
সেদিন রাতেও বৃষ্টি হচ্ছিল। পেট চালানোর জন্য তখন বাধ্য হয়ে টিউশনি করা শুরু করেছি। প্রতিদিন দুইটা কি তিনটা টিউশনি থাকে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলে। বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাতই হয়ে যায়। রাতের বেলা বাসায় ফিরতে গিয়েই আবারও আমার চিনির সাথে দেখা হয়ে গেল! ঠিক একই স্থানে। প্রথম চিনিকে আমি ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেও ঠিক একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিলাম নিজের বাসার দিকে। আমি প্রথমে তাকে খেয়াল করি নি। তবে একেবারে কাছে যখন চলে এসেছি তখনই দেখতে পেলাম তাকে। কালো একটা শাড়ি পরে রয়েছে। কালো ব্লাউজ। তবে গায়ের রঙ একেবারে দুধে আলতার মত। এই অন্ধকারের ভেতরেও কেমন যেন আলোকিত হয়ে আছে। আমি তার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে কিছু সময় স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। এই মেয়েকে আমি এর আগে কোন দিন এই এলাকাতে দেখি নি। কারণ এই চেহারা একবার দেখলে সেটা মনে থাকবে। আর রাতের বেলা এই গলিতে সাধারণত মানুষ থাকে না। এই গলির শেষ মাথায় আমার বাসা, আর গলিটা দিয়ে বাইরে বের হওয়া যায় না। কেবল মাত্র এই গলিতে যাদের বাসা তারাই সাধারণত এই গলির ভেতরে ঢোকে। হিসেবে গলিটা নির্জনই বলা চলে। এমন একটা সময়ে তাই এই মেয়েটার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। যদি না এই মেয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে?
কার জন্য অপেক্ষা করছে?
উত্তর পেলাম সাথে সাথেই।
মেয়েটি বলল, কেমন আছো রূপক?
মেয়েটির কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে সেই কন্ঠটা সোজাসুজি আমার বুকে এসে বিঁধল। কন্ঠটা শুনে আমার মনে হল যেন এই কন্ঠটা আমি কতদিন থেকেই না চিনি। মেয়েটি আমার দিকে এক কদম এগিয়ে এল। আমি বললাম, কে আপনি? আমার নাম কিভাবে জানেন?
মেয়েটি হাসল। সেই হাসির শব্দটা এবার আমার মস্তিষ্কে আঘাত করল। মেয়েটি বলল, রূপক, আমার চোখের দিকে তাকাও। তারপর বল যে তুমি আমাকে চেনো না?
আমি না চাইতেও মেয়েটার চোখের দিকে তাকালাম। আমাদের দুজনের চোখ যেন আটকে গেল। আমার সত্যিই এই চোখ বড় পরিচিত মনে হল। এই চোখ আমার কাছে পরিচিত। সত্যিই পরিচিত।
মেয়েটি আমার চোখে রেখে চোখ রেখেই বলল, আমার নাম চিনি। রিমেম্বার মি? তোমারই দেওয়া নাম।
আমার চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে যেতে চাইল। আমার বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল বহুগুণে। আমি চাইলেও এই অপদেবীর উপর থেকে আমার চোখ সরাতে পারছি না। আমাকে সে যেন অবশ করে ফেলেছে। আমাকে সেই যেন নিয়ন্ত্রণ করছে।
চিনি বলল, আমাকে তো তাড়িয়ে দিয়েছিলে তা এখন ভাল আছো তো?
আমি কোন কথা বললাম না। আমার অবস্থা তার অজানা থাকার কথা নয়। তার কন্ঠে তো সেই উপহাসের ছায়া আমি দেখতে পাচ্ছি। চিনি আবারও বলল, কই বল, ভাল আছো?
-তুমি কি সত্যিই ঐ মানুষগুলোকে মেরে ফেলেছো?
-আমি কাউকে মারি নি। আমি কেবল ওদের ভাগ্যকে তোমাকে এনে দিয়েছি। আর কিছু না।
-ভাগ্য নিয়ে নিলে মরে যাবে?
-ভাগ্য ছাড়া মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভবই না। এই যেমন ধর তুমি সিঁড়ি দিয়ে নামছো, একটার পরে একটা পা ফেলছ, একটা পা পিছলে গেল তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়লে একেবারে মাথাটা গিয়ে পড়ল সিঁড়িতে। এটা হচ্ছে না। কারণ তুমি ভাগ্যবান কিন্তু যখন ভাগ্য তোমাকে ছেড়ে যাবে তখন পদে পদে এই বিপদে পড়বে। তুমি আসলে নিজেকে যতটা দুর্ভাগ্যবান ভাবছ তুমি ততটা নাও। নয়তো এতোদিনে কবেই মারা পড়তে।
-সেটাই ভাল হত। এই জীবন রেখে লাভ কী!
হ্যা আমি অনেকবারই আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছি। কিন্তু সাহসের অভাবে সেটা করতে পারি নি।
চিনি হাসল। তারপর বলল, তুমি চাইলে আমি আবারও আসতে পারি তোমার কাছে।
-মানে?
-মানে ভাগ্য আবারও তোমার প্রতি সুপ্রসন্ন হবে?
-তার মানে আবারও মানুষ মরবে আমার জন্য?
-অন্যের কথা কেন ভাবছো? কে তোমার কথা ভাবে? কেউ ভেবেছে? তোমার নিজের পরিবার তোমার কথা ভাবে না। কোন বন্ধু বান্ধব খোঁজ নেয় না। তুমি কেমন আছো কেউ ভেবেও দেখছে না। তোমার সেই ভালোবাসার মানুষ, সে কোথায় এখন? একবারও তোমার কথা ভাবে? তাহলে তুমি কেন ভাবছো?
-না আমি এটা চাই না। আমার কপালে যা লেখা আছে তাই হোক। আমি অন্য কারো ভাগ্য নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।
চিনির মুখে এবার একটা আলাদা হাসি দেখতে পেলাম। সে বলল, আমি জানি অন্যের কথা মানুষ ভাবে না। প্রতিদিন কতশত মানুষ মরে যায়, কারো কিছু যায় আসে না। মূলত তুমি ভয় পাচ্ছো যে তোমার কাছের মানুষগুলো তোমার কারণে মারা যাচ্ছে। যাও তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তোমার পরিচিত কারো ভাগ্য চুরি করে তোমাকে দিব না। এমন সব মানুষের ভাগ্য তোমাকে দিব যাদের তুমি চেনোও না। চলবে?
আমি আবারও বললাম, আমার অন্যের ভাগ্য চাই না। তোমার সাথে আর দেখা করতেও চাই না। তুমি চলে যাও।
এই বলে আমি আর দাঁড়ালাম না। সোজা বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। বুকের ভেতরে একটা ভয় ভয় করছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি চিনি মানে সেই অপদেবী আমার উপরে হামলে পড়বে। হামলে না পড়লেও আমার নিজের যে অবশিষ্ট ভাগ্যটুকু আছে সেটাও বুঝি সে নিজে অন্য কাউকে দিয়ে দিবে। সিঁড়ি ওঠার সময় আমি খুব সাবধানে উঠছিলাম। সত্যি উঠতে গিয়ে যদি পা পিছলে যায় বা অন্য কোন কারণে যদি আমি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ি নিশ্চিত মৃত্যু। জীবনের প্রতিটা বাঁকে বাঁকে এই রকম মৃত্যু ফাঁদ রয়েছে। বাস থেকে নামতে গিয়ে যদি ঠিকমত পা ফেলতে আমরা ব্যর্থ হই তখনও কিন্তু মানুষ মারা যেতে পারে আর তখন যদি কোন গাড়ি এসে হাজির হয় তবে তো কথাই নেই।
পরের বিকেলেই বড় বিপদ টের পেলাম। সেদিন তিনটা টিউশনি ছিল। তিনটাই ছুটে গেল। প্রতিটা টিউশনিতে যাচ্ছি, পড়িয়ে বের হওয়ার সময়ে হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে আমাকে বলা হল যে আপাতত আর আমার আসা লাগবে না। পরে দরকার হলে জানাবে।
আমি এবার সত্যিই চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। সামনের দিন যে আসলে কিভাবে চলবে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন গলির মুখে আসতে গিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হলাম তখন আমার ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙ্গে গেল। বেতনের টাকা সব ওরা নিয়ে গেল। সাথে মোবাইল আর আমার হাতের ঘড়িটাও। যাওয়ার সময় কয়েকটা ঘুষি আর লাথিও মেরে গেল। রাস্তার উপরেই পড়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময়। সত্যি বলতে কি উঠতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল যদি এটা মহাসড়ক হত তাহলে কোন গাড়ি এসে আমার উপর দিয়ে চলে যেত। জীবনের সব ঝামেলা শেষ হয়ে যেত। আমি আসলেই ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর যেন টিকতে পারছি না।
কত সময় আমি রাস্তার উপরে শুয়ে ছিলাম জানি না, একটা সময়ে মৃদু হাসির আওয়াজ পেলাম। আমার হাসিটা চিনতে মোটেই কষ্ট হল না। তারপরই কানের কাছে পরিচিত আওয়াজটা শুনতে পেলাম। ‘আমি কিন্তু এখনও আছি। শুধু একবার হ্যাঁ বল’।
সত্যি বলতে কি আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। আমি সেখানেই শুয়ে থাকা অবস্থায় মনে মনে বললাম, আমার এই দুর্ভাগ্যের জীবন থেকে মুক্তি দাও।
দুই
রাতের বেলা আমি কিভাবে বাসায় পৌঁছেছিলাম সেটা আমার মনে নেই। কেবল আমার মনে আছে যে কেউ আমাকে যেন ধরে হাঁটতে সাহায্য করেছিল। সেই কেউটা যে কে সেটা আমি জানি তবে নিশ্চিত করে বলতে পারব না। অথবা এমন হতে পারে যে রাস্তায় দিয়ে যাওয়ার সময়ে কোন লোক আমাকে সাহায্য করেছিল।
তবে পরদিন বিকেল নাগাদ আমি টের পেয়ে গেলাম যে আমার উপর আবারও ম্যালেফিকার কৃপা বর্ষিত হয়েছে।
একেবারে দুপুর পর্যন্ত আমি শুয়ে থাকলাম। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে আজকে পড়াতে যাব না। হয়তো পড়াতে গেলেই এই টিউশনিটাও চলে যাবে। আমি শুয়েই রইলাম। দুপুরে যখন তীব্র ক্ষুধা লাগল তখন উঠে বিস্কুট আর চিঁড়া ভিজিয়ে খেলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে কী করব তখনই দরজায় টোকা পড়ল।
আমি উঠে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলাম বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। তার পেছনে দুইজন পুলিশের সিপাহী। বাড়িওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল রাতে কি তোমাকে ছিনতাইকারী ধরেছিল?
আমি আসলে এমন প্রশ্ন শুনবো ভাবি নি। একটু অবাক হলাম। কালকে আমার ছিনতাইকারী ধরার কথা পুলিশের জানার তো কথা না। আমি উত্তর না দিয়ে মাথা ঝাঁকালাম কেবল।
বাড়িওয়ালা একটু বিরক্ত কন্ঠে বললেন, তো এটা জানাবে আমাকে। তুমি আমার বাসায় থাকো আর আমার গলিতে তোমাকে ছিনতাই কারী ধরবে তুমি চুপচাপ বসে থাকবে!
-সরি আঙ্কেল। আসলে ভাবছিল একটু পরে আপনাকে বলব!
যদিও এটা মিথ্যা কথা। আমার আসলে বলার কোন ইচ্ছেই ছিল না।
বাড়িওয়ালা বললেন, ইনাদের সাথে যাও থানাতে। সেখানেই তোমার জিনিসপত্র পেয়ে যাবে। থানা থেকে এসে আমার বাসায় আসবে। মনে থাকবে?
-জ্বী আঙ্কেল!
আমি থানাতে যাওয়ার পরে ওসি সাহেব আমাকে যা জানালো তা শুনে আমি আমার ভাগ্যকে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার ভাষ্যমতে গতকাল রাতে আমার কাছ থেকে ছিনতাইয়ের পরে তারা গিয়ে হাজির হয়েছিল গড়ের মাঠে। ওটা আমাদের এলাকার শেষ মাথায় অবস্থিত। বিকেলে খেলাধুলা হলেও রাতে সেখানে মাদকের আড্ডা বসে। সেখানে গিয়ে ওরা ডাল খাচ্ছিল। তখনই ছিনতাইয়ের টাকার ভাগ নিয়ে মারামারি বেধে যায় ওদের ভেতরে। সেখানেই একজনকে ইট দিয়ে থেঁতলে মারে বাকিরা। অন্য আরেকজনের অবস্থাও কাহিল। তৃতীয়জন কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সকালে লোকজন তাদের দেখে। পুলিশে খবর দেয়।
ওদের কাছ থেকেই আমার মানিব্যাগ আর আমার ফোন পাওয়া যায়। একজন স্বীকার করে যে রাতে কী কী হয়েছিল। থানার একজন সিপাহী আমার আইকার্ড দেখে চিনতে পারে।
ওসি সাহেব মানিব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন, কত টাকা ছিল আপনার মানিব্যাগে?
-এই হাজার পনেরোর মত!
-এতো টাকা কেন?
-আসলে গতকালই টিউশনির বেতন পেয়েছিলাম। সেটাই মানিব্যাগে ছিল।
-আচ্ছা। সব টাকা এখানে নেই। তের হাজারের কিছু বেশি আছে। সম্ভবত ওরা খরচ করে ফেলেছে। এই মানিব্যাগ ফেরত পাওয়ার জন্য অনেক লম্বা প্রসেস থাকে। অনেক ঝামেলা হবে আপনার। আপনি যেহেতু আবেদিন সাহেবের ভাড়াটিয়া তাই আপনাকে এতো ঝামেলায় ফেলছি না। মানিব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে যান। এটা ওদের কাছে পাওয়া গেছিল এমনটা আমরা এন্ট্রি করব না। তাহলেই ঝামেলা শেষ। ফোনটার লক একটু খুলবেন প্লিজ।
আমি ফিঙ্গার দিয়ে ফোন খুললাম। ওসি সাহবে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন থানা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই আমি আমার মানিব্যাগ আর মোবাইল ফিরে পেয়েছি। সত্যিই এটা কিভাবে হল?
তারপরেই আমার রাতের কথা মনে পড়ল যে রাতে আমি কী বলেছিলাম। তাহলে সে ফিরে এসেছে আবার!
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হল। আমি রাস্তায় কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে আমি যখন বাসায় যাব আজকে তখন আমি চিনিকে দেখতে পাব!
পরিশিষ্টঃ
আমি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে থাকি। রাত পার হয়েছে অনেকটা। সারারাত চাইলেই তো আমি বাসার বাইরে থাকতে পারব না। আমাকে তো বাসায় ফিরতেই হবে। আমি দরজার কাছে এসে থামলাম। আমি জানি এই দরজা খুললে আমি কাকে দেখতে পাব। আমি জানি আমি দরজা খোলা মাত্রই আমি দেখতে পাব একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।