জিসু এমন ভাবে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে এই কথা আমরা কেউ ভাবতে পারি নি। পুরো একটা মাস ধরে পুলিশ তার খোজ করল কিন্তু তার কোন খোজ বের করতে পারল না। সে যেন একেবারে কর্পুরের মত গায়েব হয়ে গেছে। তাকে শেষবারের মত দেখা গেছে শাহবাগ থেকে মেট্রোতে উঠতে। রাত নয়টা চার মিনিটের মেট্রোতে সে চড়েছিল। তার মেট্রোকার্ড শাহবাগ স্টেশনে এন্ট্রি পাঞ্চ হয়েছে। কিন্তু একজিট পাঞ্চ হয় নি। সেদিনের রাত নয়টার পরে শাহবাগের পরের সব স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়েছে। অন্য কোন স্টেশন থেকে বের হতে দেখা যায়নি। ব্যাপারটা এমন যেন সে মেট্রোতে উঠেছে বটে তবে সেই মেট্রো থেকে আর নামে নি। এটাই সব থেকে চিন্তার ব্যাপার। জিসু যেন একেবারে হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে। সবগুলো মেট্রো স্টেশন সব গুলো ভাল করে খুজে দেখা হয়েছে কিন্তু জিসুর দেখা পাওয়া যায় নি। জিসুর শেষ মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছে উত্তরা সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন। তার পর থেকেই ওর সিগনাল গায়েব। কারো কোন ধারণাতেই নেই যে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল। কিন্তু আমি জানি জিসু কোথায় হারিয়ে গেছে। যদিও জিসু যখন আমাকে বলেছি আমি বিশ্বাস করি নি তবে এখন আমি জানি যে জিসু সত্যি কথা বলছিল।
জিসুর পুরো নাম জিনাত সুইরায়া। দুই নামের প্রথম দুই অক্ষর নিয়ে জিসু। ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয় নাজনীন ম্যামের কারণে। নাজনীন ম্যাম একটা প্রোজেক্টে আমাকে নিয়েছিলেন। কাজের কদিন পর দেখা গেল কাজের চাপ অনেক। আমার একার পক্ষে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তখন ম্যাম জিসুকে নিয়ে এলেন। জিসু আমাকের ডিপার্টমেন্টের ছিল না। আমরা এক সাথে কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ওর সাথে টুকটাক কথা হতে লাগল। প্রথম প্রথমে জিসুকে বেশ চুপচাপই মনে হয়েছিল। সব সময় যেন সংকুচিত অবস্থায় থাকে। তবে এক সময়ে আমার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেল। আমি বলব না যে আমাদের ভেতরে প্রেম শুরু হয়েছিল তবে শুধু বন্ধু ছিলাম না আমরা। একটু যেন বেশি কিছুই ছিলাম।
একদিন রাতের বেলা বাসায় পৌছে দিচ্ছিলাম। আমরা একটা সাইট ভিজিটে গিয়েছিলাম ম্যামের কাজ। ঢাকাতে ফিরতে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। ম্যামের বাড়ি ওয়ারিতে। তাই আমরা দুজন ওয়ারিতেই নেমে পড়লাম। ম্যাম আমাকে বলল যেন আমি জিসুকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দেই। আমার কোন আপত্তি ছিল না। ওকে নিয়ে মতিঝিল থেকে মেট্রোতে উঠলাম। শুক্রবার ছিল বলে মতিঝিলের দিকে মেট্রোটা একেবারে ফাঁকাই ছিল। সেইদিনই প্রথম জিসু আমাকে কিসারাগি স্টেশনের গল্পটা বলল।
-তুমি কিসারাগি স্টেশনের নাম শুনেছ?
-জাপান নাকি কোরিয়ায়?
-জাপান!
-নাহ। বিশেষ কিছু?
-হ্যা।
আমি কী বলব ঠিক বুঝলাম না। আমার কোন ধারণাই ছিল না যে এই স্টেশনটা কেন বিখ্যাত। আমি জিসুকেই বলতে দিলাম। জিসু কিছুটা সময় চুপ করে বলতে শুরু করল গল্পটা।
২০০৪ সালের এক রাতে হাসুমি তার নিয়মিত রুট শিন-হামামাতসু স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠল। তার বগিতে অল্প কিছু মানুষ ছিল, তবে সবাই ছিল ঘুমিয়ে। বেশ কিছু সময় ধরে ট্রেন চলার পরে হাসুমি লক্ষ্য করল যে ট্রেনটি কোনো স্টেশনে থামছে না। এতো সময়ে তার বাসার স্টেশনে চলে আসার কথা। এতো সময় তো লাগে না! সে বাইরে তাকিয়ে দেখল যে বাইরের দৃশ্যও অচেনা মনে হচ্ছে। সে তখন ফোনে ২চ্যান (2channel) বের করে এই কথা লেখা। টুচ্যান জাপানের নামক একটি জনপ্রিয় অনলাইন ফোরাম। সে লাইভ আপডেট দিতে থাকে। অনেকেই তার সাথে যুক্ত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর ট্রেনটি একটি অজানা স্টেশনে থামে। হাসুমি ফোরামে জানায় যে ট্রেন স্টেশনের নাম “কিসারাগি স্টেশন”।
হাসুমি ফোরামে লেখে যে সে এই স্টেশনের নাম আগে কখনো শোনেনি। তার মোবাইলের ম্যাপে এই স্টেশনের কোনো অস্তিত্ব নেই। একেবারে নির্জন একটা স্টেশন, এখানে কোনো যাত্রী বা স্টাফও নেই। সে স্টেশনে নেমে বাইরে বেরিয়ে দেখল, চারপাশে শুধু অন্ধকার আর জঙ্গলে ভরা। ফোরামের অন্যান্য ইউজাররা তাকে স্টেশনের ভেতরেই থাকতে বলে। পরের ট্রেনে যেন সে ফিরে আসে। তবে হাসুমি জানায় যে আর কোন ট্রেন আসছে না।
কিছু সময় পরে হাসুমি একটা টানেলের কথা বলে। সে জানায় যে হাঁটতে হাঁটতে একটি টানেলের কাছে এসে পৌছিয়েছে এবং ভেতর থেকে অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফোরামের লোকজন তখন তাকে টানেলের ভেতরে ঢুকতে মানা করে তবে হাসুমি ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পরেছে। এরপর তার পোস্টগুলো ক্রমশ অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। একবার সে বয়স্ক কোনো মানুষের সাথে দেখা হওয়ার কথা বলে, সেই লোক তাকে শহরে পৌছে দেবে গাড়িতে তুলে নেয়। তার সর্বশেষ মেসেজ ছিল যে লোকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলেন, যিনি তাকে কাছাকাছি শহরে পৌছে দেওয়ার কথা বলে। হাসুমির সর্ব শেষ মেসেজ ছিল “আমার মোবাইলের ব্যাটারি প্রায় শেষ, আমি ভয় পাচ্ছি।” এরপর হাসুমির কাছ থেকে আর কোন কথা শোনা যায় নি।
আমি চুপচাপ শুনে গেলাম। আমার কাছে পুরো গল্পটা বেশ ভালই মনে হল। তবে এটা সম্ভব আরবান জেলেন্ড। জাপানে এই রকম অসংখ্য আরবান লেজেন্ড রয়েছে। আমি বলল, এটা জাপানিজ আরবান লেজেন্ড?
-অনেকটা সেই রকমই। তবে অনেকেই বিশ্বাস করে যে এটা বাস্তবে হয়েছে। সেদিন ট্রেনটা কোন এক উপায়ে ভিন্ন এক ডাইমেনশনে চলে গিয়েছিল। সে ভিন্ন এক জগতে চলে গিয়েছিল।
আমি একটু অবাক হয়েই জিসুর দিকে তাকালাম। তার কারণ হচ্ছে জিসু চোখে মুখের ভাব দেখে আমার কেবল মনে হল যে জিসু এই ব্যাপারটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। আমি বলল, তুমি সত্যিই এটা বিশ্বাস কর?
-হ্যা করি।
আমি কিছু না বলে কিছু সময় জিসুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার চেহারার ভাব দেখেই জিসু বলল, বিশ্বাস করার কারণ কী জানো?
-কী কারণ?
-কারণ আমি সেই স্টেশনে আমি গিয়েছি।
এবার আমি সত্যিই চমকে গেলাম। আমার ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাস হল না। আমি বেশ অবিশ্বাসের চোখেই জিসুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা সময়ে বললাম, তুমি জাপান গিয়েছো?
-না জাপান যেতে হবে না। কিসারাগিতে যাওয়ার জন্য জাপানে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি যে কোন ট্রেনে করেই সেখানে যেতে পারো। যে কোন সময়ে যে কোন ট্রেনের সামনেই সেই ডাইমেনশনের রাস্তাটা খুলে যেতে পারে। এমন কি এই মেট্রোটাও যেতে পারে কিসারাগিতে। আমার সাথেও এমন হয়েছে।
আমি বললাম, তা তুমি ফিরে এলে কিভাবে? হাসুমি তো হারিয়ে গিয়েছিল!
জিসু বলল, হাসুমি হারিয়ে গিয়েছিল কারণ হাসুমি ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিল। ট্রেন থেকে না নামলে সে আবারও নিজের এই ডাইমেনশনে চলে আসতো।
-তুমি দেখছি একেবারে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছো!
আমি অবশ্য আর কিছু বললাম না। জিসুকে আমার কোনদিনই অতিপ্রকৃস্ত মনে হয় নি। আমি আর বেশি কিছু বললাম না। মানে এমন কিছু বললাম না যাতে করে জিসুর মন খারাপ হয়। ও যা বিশ্বাস করে করুক।
জিসু বলল, এই কথাটা আমি আর কাউকে বলি নি কোন দিন । তোমাকে শুধু বললাম। তোমাকে বলার কারণ হচ্ছে আমি যদি কোন দিন হারিয়ে যাই তবে ধরে নিবে যে আমি স্টেশনে গিয়েই হারিয়ে গেছি। এবার যদি আবারও আমার ট্রেন এই স্টেশনে ঢোকে তবে আমি এবার ঠিক ঠিক নেমে পড়ল আমি দেখতে চাই যে সেখানে কী আছে!
এরপর জিসু আমার সাথে এই কিসারাগি স্টেশন নিয়ে কোন কথা বলে নি। মাস দুয়েক কেটে গেল স্বাভাবিক ভাবেই। আমরা আমাদের স্বাভাবিক কাজ করে গেছি। আর তার পরেই এই ঘটনা। জিসুকে আর খুজে পাওয়া গেল না। পুলিশ জোর তল্লাসী চালালো, আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করল। আমি সব কিছু জানালাম তবে অবশ্যই কিসারাগি স্টেশন নিয়ে কোন কথা বললাম না। বলার কোন কারণও ছিল না। এমন কথা আমি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। পুলিশ তো করবেই না বরং আমার উপরে সন্দেহ চলে আসবে। আমি তাই কোন কথা বললাম না। জিসু যে আমাকে এমন কোনো কথা বলেছে সেটা আমি ভুলে গেলাম। জিসু নামের একটা মেয়ের সাথে যে আমার কোনো কালে পরিচয় ছিল সেটাও আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ভুলে যাওয়া হল না। কারণ আমিও সেই কিসারাগি স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম একদিন!
দুই
ততদিনে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছি। আমার অফিস মিরপুর দশে। মিরপুরেই বাসা নিব ভেবেছিলাম তবে কেন জানি মনের মত বাড়ি খুজে পেলাম না। আগে ছাত্র অবস্থায় যেখানে সেখানে মাথা গোজার ঠাই হলেই চলে যেত। কিন্তু এখন টাকা পয়সা আসার কারণে শান্তিতে থাকাটা প্রধান প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়াল। বাসা নিলাম উত্তরাতে। মেট্রোর ডিপো স্টেশন থেকে কাছেই। প্রতিদিন হেটেই মেট্রোতে উঠি। কয়েক মিনিটেই পৌছে যাই অফিসে আবার অফিস থেকে কয়েক মিনিটেই চলে আসি বাসায়। জীবন শান্তিময় হয়ে উঠল। জীবনে সব কিছু যখন স্বাভাবিক ভাবে চলছে তখনই আমি অস্বাভাবিকতা সামনে এসে হাজির হলাম। আমার ট্রেন গিয়ে থামল কিসারাগি স্টেশনে।
সেদিন ছুটির দিন ছিল। ছুটির দুপুর থেকে উত্তরামুখী মেট্রোতে ভীড় থাকে। সবাই এইদিন মেট্রোতে চেপে ডিয়াবাড়ি দিয়ে হাজির হয়। অন্য দিকে মতিঝিলমুখী ট্রেনে আবার ভীড় থাকে কম। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। আমি সেদিন সকালেই বসুন্ধরাতে গিয়েছিলাম মুভি দেখতে। মুভির পরে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিতে দিতে প্রায় নয়টা বেজে গেল। এই সময়ে মেট্রোতে এমনিতেই ভীড় থাকে কম। নয়টার পরে টিকিট বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেবল মেট্রোপাসে করে যাওয়া যায়।
আমি শাহবাগ থেকে যখন মেট্রোতে চড়ে বসলাম তখন আমার বগিতে হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী। মিরপুর দশে আসার সময়ে দেখলাম যে প্রায় সবাই নেমে গেল। নতুন করে কেউ আর উঠল না আর। এমনটা স্বাধারণত হয় না। মিরপুর দশ নম্বর থেকে অনেকেই ওঠে। পুরোবগিতে অল্প কয়েকজন মানুষ। বেশ মজাই লাগছিল। ছুটির দিন ছাড়া এমন দৃশ্য কল্পনা করা যায় না। আমি অবশ্য আবার নিজের ফোনেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। পল্লবীতে এসে দেখলাম পুরো বগিটা ফাঁকা হয়ে গেল। কেবল কোনার দিকে একজন মাত্র মানুষ বসে ছিল। এই ছুটির দিনে মানুষজন কম থাকে আমি জানি কিন্তু একেবারে একজন থাকে না কখনই। এই শহরে এতো মানুষ যে এটা আসলে সম্ভবই না। আমার মনের ভেতরে কী যেন একটা কু ডেকে উঠল। তবুও আমি কাকতালীয় ঘটনা ভেবেই আমার নিজের মোবাইলের দিকে মনযোগ দিলাম।
তারপর ব্যাপারটা ধরতে আমার আরও বেশ কিছুটা সময় পার হল। আমি নিজের মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলেই আমি তখন ধরতে পারি নি। পল্লবি থেকে উত্তরা সাউথ স্টেশনের রাস্তাটা সব থেকে লম্বা। এই গ্যাপটা অন্যান্য যে কোনো গ্যাপের থেকে বড়। তাই একটু বেশি সময় লাগে। কিন্তু প্রায় পনের মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মেট্রো থামল না তখন আমি মুখ তুলে তাকালাম। কারণ এতো লম্বা সময় তো লাগে না। আমি কাচের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আকাশে চাঁদের আলো ছিল। সেই স্বল্প আলোতে আমি ক্যান্টনমেন্টের এরিয়া দেখতে পেলাম না। এখানে রাতের বেলা বেশ আলোকিত থাকে অথচ তার বদলে আমি দেখতে দেখতে পেলাম ঘন জঙ্গল। আমার নিচে আমি কেবল গাছের মাথা দেখতে পাচ্ছি। আমি তীব্র চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়।
আমার মনে একটা চিন্তা এসে জড় হল। আচ্ছা আমি ট্রেনের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি? আমি জানি না। আমি কেবল বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনটা তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। আমি জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমার বুকের ভেতরে দুরুদুরু করছে। আমার মনে কেবল একটা আশার সঞ্চারণ আছে যে ট্রেনের ভেতরে আরও অনেক মানুষ রয়েছে। আমার বগিতে কেবল একজন থাকলেও আরও মানুষ আছে অন্যান্য বগিতে। এই চিন্তাটা আসতেই আমি আমার পাশের বগির দরজার দিকে তাকালাম। তখনই আমার ভয়টা বেড়ে গেল একটু।
পাশের বগির দরজা দিয়ে ওপাশটা দেখা যাচ্ছে না। সেখানে অন্ধকার ছেঁয়ে আছে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা না। পুরো মেট্রোটা সব সময় আলোকিত থাকে। আমার বগিতে ঠিকই আলো রয়েছে। কিন্তু ওপাশের বগিটা একেবারে অন্ধকার, দেখে মনে হচ্ছে যেন ওপাশে আসলে কিছুই নেই। উল্টাপাশের বগির দরজার অবস্থাও একই রকম। আমি এবার আমার বগিতে থাকা মানুষটার দিকে তাকালাম। সে একই ভাবে বসে রয়েছে। কোনো নড়াচড়া করছে না। আমার এখন কী করা উচিৎ? আমি কি লোকটার কাছে গিয়ে কথা বলব? তাকে গিয়ে জানতে চাইবো?
আমি আমার মোবাইলের দিকে তাকালাম। আমার মনে হল পরিচিত কাউকে একটা ফোন করা দরকার। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। আমার ফোনের নেটওয়ার্ক একেবারে জিরো দেখাচ্ছে। এমন সাধারণত হয় না। হওয়ার কথা না। আমার এখন ঐ লোকটার সাথেই কথা বলব ঠিক করলাম। কিন্তু আমি যখন উঠতে যাবো তখনই মনে হল ট্রেনের গতি কমে এল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনটা স্টেশনের ভেতরে ঢুকল।
ট্রেনটা থেমে গেল। তবে আমি সেই আগের অবস্থাতেই বসে রয়েছে। কারণ কাঁচের জানালা দিয়ে আমি যে স্টেশন দেখতে পাচ্ছি সেটা মোটেই উত্তরা সেন্ট্রান স্টেশন নয়। তাহলে আমি কোথায় চলে এলাম? ট্রেন কোন স্টেশনে চলে এল? আমি কী করবো এখন? এই স্টেশনে নেমে যাবো? কিন্তু এই রাতের বেলা এই স্টেশনে নামা কি ঠিক হবে?
আমি যখন এই সিদ্ধান্ত নিবো কিনা ভাবছি তখন ট্রেনের দরজা খুলে গেল। আর আমার কামরার একমাত্র লোকটা উঠে দাঁড়াল। আমিও উঠতে যাবো তবে আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা হাতের ইশারায় উঠতে মানা করল। আমি বসে পড়লাম। সে নেমে যাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যেখানে নামার কথা সেখানেই নামো। ভুল স্টেশনে নেমো না।
তারপরই লোকটা বের হয়ে গেল। তার পরপরই ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তার কয়েক মুহুর্ত পরে ট্রেনটা ঝাকি দিয়ে চলতে শুরু করল। ঠিক ট্রেনটা স্টেশন ছাড়ার আগে আমি স্টেশনের নামটা দেখতে পেলাম।
কিসারাগি স্টেশন!
সাথে সাথে আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল। আমার জিসুর কথা মনে পড়ল। জিসু হারিয়ে গিয়েছিল। নাকি জিসু এই স্টেশনে নেমে পড়েছিল?
আমি ঠিক ভাবে কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। আমার কাছে সব কিছু গোলমাল মনে হচ্ছিল। কিন্তু যখন ট্রেন আবার একটা স্টেশনে এসে থামল তখন আমার তন্ময় ভাঙ্গল। দেখতে পেলাম ট্রেনটা সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে থেমেছে। স্টেশনটা আমার একেবারে পরিচিত মনে হল। এই স্টেশনেই আমি প্রতি নামি, এখন থেকেই প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার জন্য মেট্রোতে উঠি। এই সিড়ির কাছে একেবারে প্রথম গেট দিয়েই আমি মেট্রোতে উঠে থাকি।
যখন গেটটা বন্ধ হয়ে গেল তখন আমার বাস্তবে ফিরে এলাম পুরোপুরি। তবে তত সময়ে দেরি হয়ে গেছে। গেট বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আমার মনের ভেতরে একটা সুক্ষ দুঃচিন্তা অনুভব করলাম। লোকটা বলেছিল ভুল স্টেশনে না নামতে। আমি তো সঠিক স্টেশনেও নামতে পারলাম না। সামনের স্টেশনে নামতে পারব তো? যদি না নামতে পারি তাহলে? যদি আবারও আমি আগের সেই কিসারাগিতে চলে যাই তখন?
তবে তেমন কিছুই হল না। মেট্রোটা শেষ পরিচিত স্টেশনেই থামল। অন্যান্য বগি থেকে অনেকেই নেমে এল। আমি ভয়ে ভয়ে স্টেশন থেকে নেমে এলাম। আমার তখনও ভয় করছিল। ভয় হচ্ছিল যে আমি হয়তো অন্য জগতে চলে যাবো। তবে স্টেশন থেকে একটা রিক্সা নিয়ে আমি বাসায় ফিরে এলাম। নিরাপদে।
পরিশিষ্ট
আমি জানি না আমার কাছে আসলে কী হল! আমি কিভাবে সেই কিসারাগি স্টেশনে পৌছে গিয়েছিলাম। এমন হতে পারে যে ট্রেনটা চলার সময়ে অন্য কোন ডাউমেনশনের দরজা খুলে গিয়েছিল। চলে গিয়েছিল সেই কিসারাগিতে। হাসুমির গল্পটা তাহলে ভুল ছিল না। জিসুর গল্পটাও। জিসু হারিয়ে যায় নি বরং সে চলে গেছে এই জগতে! আচ্ছা সেখানে সে কেমন আছে?
আমি যদি স্টেশনে নেমে পড়তাম তাহলে আমিও নিশ্চিত ভাবেই হারিয়ে যেতাম। জিসুর মত আমার খোজও কেউ পেত না। তখন আমার ঐ লোকটার কথা মনে পড়ল। সে আমাকে নামতে মানা করে ছিল। কিন্তু সে তো নিজেই নেমে গিয়েছিল। সে কি জানতো সে কোথায় যাচ্ছে? নাকি লোক সেখানকার বাসিন্দা? আমার কাছে কোন উত্তর নেই।
জানি না সামনে আবারও আমি কোণ দিন এই স্টেশনের দেখা পাবো কিনা, তবে দেখা পেলেও আমি এই স্টেশনে নামব না। এখানে না নামলে কোন সমস্যা নেই।
আপনারা যারা নিয়মিত মেট্রোতে যাওয়া আসা করেন, তারা সাবধানে থাকবেন। বিশেষ করে পল্লবী স্টেশনের পরে যদি অন্য কোনো স্টেশনে পৌছে যান তবে ভুলেও সেখানে নেমে পড়বেন না। একবার স্টেশনে নেমে পড়লে কিন্তু আর এই জগতে ফিরে আসতে পারবেন না।
দারুণ!
পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমিই ট্রেনের সিটে বসে আছি। শেষ গিয়ে এক অদ্ভুত ভয়ের সাথে কৌতূহল পূর্ণ সমাপ্তি। তবে শেষটা ভালো হয়েছে আরও বেশি, ওয়ার্নিংটা একটা বাস্তবতার ভাইব দিচ্ছে।
গল্পের এ্যাডাপশন দারুণ, সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এখান থেকে নতুন আরেকটি এ্যাডভাঞ্চার গল্পের সূচনাও হতে পারে। হবে কি….?!
সম্ভাবনা আছে। এখান থেকে আরেকটা পর্ব লেখার ইচ্ছে আমার আছে তবে এখন না। পরে। দেখা যাক কবে লেখা যায়।