রিমি আর আমার গল্প

oputanvir
4.6
(78)

দুপুরের কিছু আগে পিয়ন এসে জানালো যে আমার কাছে একজন গেস্ট এসেছে । আমার সাথে দেখা করতে চায় । একটু অবাক হলাম । কারণ আমার কাছে আসার আগে আমাকে সবাই ফোন করে আসে সাধারনত । কে এমন যে ফোন না করেই চলে এসেছে !
কৌতুহল নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে হাজির হয়ে দেখি রিমি বসে আছে । আমাকে ঢুকতে দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল । আমি বললাম, আসবি আগের থেকে ফোন দিবি না ?
রিমি বলল, তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম ।
-কী আমার বাহারী সারপ্রাইজ ! কেন এসেছিস?
-বারে আসতে পারি না?
-আমি কাজ করছি । কাজের সময় কেন এসেছিস বল ?
-আমি তোমার সাথে লাঞ্চ করতে এসেছি ।

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । মেয়েটা দেখলাম বেশ সেজে গুজেই এসেছে । নীল রংয়ের একটা কুর্তা পরেছে । নিচে পরেছে সাদা লেগিংস । আর কালো ওড়না । মুখে মেকাপ দিয়েছে একটু তবে ঠোঁটে একদমই লিপস্টিক দেয় নি । রিমি ঠিক জানে যে আমি কোন ধরণের পোশাক পছন্দ করি ।

আমি বললাম, আমি কাজ শেষ করি তারপর ।
-ওকে আমি অপেক্ষা করছি । তুমি কাজ শেষ করে আসো ।
আমি আমার ডেস্কে ফেরত গেলাম । হাতের কাজটা তখনও শেষ হয় নি । লাঞ্চ আওয়ার হতে এখনও কিছু সময়ব বাকি আছে । তবে কেন জানি রিমিকে একা একা বসিয়ে রাখতে ইচ্ছে হল না । কবীর ভাইকে বললাম যে একটু কাজে বের হচ্ছি লাঞ্চের পরেই বের হব। কাজটা অর্ধেক রেখেই আবার গেস্ট রুমের দিকে রওয়ানা দিলাম । আজকে একটু আগে বের হলে তেমন কিছু হবে না । আমি যখন আবার গেস্ট রুমে গিয়ে হাজির হয়েছি দেখি রিমি বের হওয়ার জন্য রেডি । যেন ও জানতোই আমি এখনই আসবো । আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলো ।

বললাম, বেশি দুরে যাবো না । ঐ যে সামনে যে রেস্টুরেন্ট টা দেখছিস । ওখানে ।
-আচ্ছা বাবা আচ্ছা । চল তো !

রিমি সম্পর্কে আমার কাজিন । ছোট চাচার বড় মেয়ে । আমার থেকে বছর পাঁচের ছোট । ছোট বেলা থেকে আমার সাথে বড় হয়েছে । ওকে ধরে কত যে মেরেছি তার কোন ঠিক নেই । তবে আমার হাতে এতো মাইর খেয়েও কোন দিন আমার পিছু ছাড়ে নি । সব সময় আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো । যখন পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতে চলে এলাম সব থেকে বেশি কান্না কাটি রিমিই করেছিলো ।

আমি চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই রিমি ঢাবিতে ভর্তি হয়ে গেল । তখন থেকে আবার নিয়মিত আমাদের দেখা হত বেশ । রিমিই আসতো বিশেষ করে । আমাকে নিয়ে এদিক ওদিক যেত । আমার পকেট থেকে টাকা খরচ করাতো আর কি !

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে রিমি একটানা বকবক করেই চলেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী নিয়ে চিন্তিত শুনি?
-আর বলিস না । বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে । এখন নতুন বাসা কই পাই ।
-কেন এতো বাসা । খুজে পাচ্ছো না?
-বাসা পাবো না কেন কিন্তু ব্যাচেলরকে বাসা দিবে কে শুনি?
-বিয়ে করে ফেলো ।
-এতো ঝামেলা একবারে নিতে পারবো না ।
-তাহলে এক কাজ কর আমাকে বউ বানিয়ে নিয়ে যাও । বলবে যে নতুন বিয়ে করেছি ।

কথাটা বলেই রিমি হেসে ফেলল । কথাটা প্রথমে শুনতে হাস্যকর মনে হলেও আমার কেন জানি মনে ধরলো । বললাম, করা যায় কিন্তু !
-করবে?
-হ্যা । তোকে বউ সাজিয়ে নেওয়া যায় । আর তুই তো আসিসই । খুব একটা ঝামেলা হবে না মনে হয় ।
রিমি বলল, কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-চাচী যদি জানে ?

আমি একটু চুপসে গেলাম । মা যদি এই ব্যাপারে জানে তাহলে অবশ্য ঝামেলা হবে । অজানা কোন কারণে আমার মা রিমিকে পছন্দ করে না । আমার তিন চাচা আর দুই ফুফুর মোট ১২ জন ছেলে মেয়ে । এদের ভেতরে আমার মা কেবল রিমিকে পছন্দ করে না । এমন কি রিমি ছোট একটা ভাই একটা বোন আছে তাদের আদর করে কিন্তু রিমিকে করে না । কেন যে করে না সেটা কেউ জানে না । তবে একটা কারণ হতে পারে যে ছোট বেলাতে একবার রিমি আমার মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছিলো ইট মেরে । যদিও শুরুটা আমিই করেছিলাম ।
অবশ্য রিমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারে নি যে এমন ভাবে আমার মাথা কেটে যাবে । আমার থেকে ও নিজেই বেশি ভয় পেয়েছিলো । আমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো একদিন ।
আমি বললাম, মা কে না বললেই হল । তুমি মুখ না খুললেই হল !

তাই ঠিক হল । পরের শুক্রবার রিমিকে নিয়ে হাজির হলাম এক বাসায় । বাসাটা ছোট দুই রুমের । প্রথম দেখাতেই পছন্দ হল বাড়িওয়ালা বললাম যে আমরা নতুন বিয়ে করেছি । প্রথমে বাড়িওয়ালা একটু সরু চোখে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে তবে রিমি এমন আচরণ শুরু করলো যে সত্যিই ও আমার বিয়ে করা বউ । আমরা মোটামুটি সবই সত্য কথা বললাম । জানালাম যে আমি চাকর করি, ও পড়াশোনা করে । বিয়ে করেছি ছয়মাস । ও হলে থাকে আমি ব্যাচেলর মেসে থাকতাম । এখন মনে হচ্ছে দুজনের একসাথে থাকা দরকার ।
কাজ হয়ে গেল । বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিয়ে দিল ।

বাসায় উঠে পড়লাম । জিনিস পত্র খুব বেশি ছিল না । রিমি আমার সাথেই ছিল সব সময় এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে ও নিজে আমাকে অনেক সাহায্য করলো । এরপর আমার জীবন শেষ সহজ হয়ে গেল । সত্যি বলতে কি সব টুকুই হল রিমির কারণেই । ও প্রায় দিনই ক্লাস শেষ করে আমার বাসায় এসে হাজির হত। ঘর দোর সব নিজেই সামলাতো । দুই রুমের একটা রুম ও নিজে দখল করে নিল থাকার জন্য । যদিও প্রতিদিন থাকতো না তবে প্রায়ই আসতো ।

কিন্তু জীবনে ঝামেলা থাকবে তা তো হয় না । কিভাবে জানি আমার মা জেনে গেল এই কথা । আমাকে কিছু বলল না তবে রিমিকে কিছু নিশ্চয়ই বলল । কী বলল সেটা আমি জানি না । পরের দিন দেখি ও নিজের সব জিনিস পত্র নিয়ে চলে যেতে উদ্যোত হল । আমি ওকে থামালাম । গেট দিয়ে বের হতে যাচ্ছিলো তার আগেই ওকে ধরে ফেললাম । বললাম, কী হয়েছে?
রিমি কিছু বলল না । তবে ওর চেহারা আমি ভাল করে খেয়াল করে বুঝলাম যে রিমি কান্নাকাটি করেছে ।
বললাম, বলবি তো কী হয়েছে?
-কিছু না । তোমার এখানে আসাটা আমার উচিৎ হচ্ছে না ।
-মা ফোন দিয়েছিলো?
রিমি কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকালো । কান্না আটকানোর প্রবল চেষ্টা করছে। তখনই বুঝলাম যে মা ফোন দিয়েছিলো । আমি জোর করে ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলাম । তারপর আলতো করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । তখনই অনুভব করলাম যে ও হু হু করে কেঁদে উঠলো । এতো তীব্র ভাবে কান্না করে উঠলো যে আমি নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম । বুঝতে পারলাম যে মা খুব ভাল করেই ওকে কথা শুনিয়েছে ।

ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, মায়ের কথাই মন খারাপ করিস না ।
কান্না বিরজিত কন্ঠে রিমি কোন মতে বলল, আমি কী করেছি বল ! আমাকে চাচী কেন পছন্দ করে না ?
-আচ্ছা মন খারাপ করিস না ।

তখন হঠাৎ আমার কী মনে হল বললাম, বেড়াতে যাবি?
রিমি তখনও আমার বুকেই মাথা গুজে কান্নাকাটি করছে ।
-জানি । যেখানে ইচ্ছে । যাবি ?
-কক্সবাজার নিয়ে যাবা?

আমি একটু ইতস্তর করলাম । এখন কক্সবাজার যাওয়া বেশ ঝামেলা । কিন্তু তারপর মনে হল যে যাওয়াই যায় । কেবল অফিস থেকে একদিন ছুটি নিলেই চলবে । তখনই কী যে আমি বললাম, চল আজই চল ।
-সত্যি ?
-হ্যা । দাড়া আমি অফিসে ফোন দিয়ে ব্যবস্থা করি ।

ছুটি মেনেস করতে সময় লাগলো না । ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই আমরা বের হয়ে গেলাম । কক্সবাজার যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা । হোটেলে চেক ইন করলাম ।

রাতে লম্বা একটা সময় সমুদ্রে হাটাহাটি রকলাম । রিমিকে কেন জানি খুব বেশি আনন্দিত মনে হল আমার কাছে । বেশ রাত করে হোটেল রুমে ফিরলাম । ডাবল বেডের একটা রুমই নিয়েছি আমরা থাকার জন্য । রাত যখন শুয়েছি রিমি অন্য বিছানা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মা জানতে পারলে কী হবে ভেবে দেখেছো?
-নাহ। ভাবতে চাই না আপাতত । এখন ঘুমা ।

আমি আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম । তবে একটু পরে অনুভব করলাম যে রিমি নিজের বিছানা ছেড়ে আমার পাশে এসে শুয়েছে । আমার কানে ফিসফিস করে বলল, তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরে ঘুমাই?
আমি সত্যিই অবাক হলাম । রিমির কন্ঠে আসলে অন্য কিছু ছিল। ঢাকাতে আমার ফ্লাটে ও অনেক দিন ধরেই রয়েছে । একেবারে আমরা বাসাতে যেমন করে থাকতাম ঠিক তেমন করেই । কোন দিন কিছু মনে হয় নি । কিন্তু আজকে রিমির কী হল !

আমি ওকে কোন ভাবেই মানা করতে পারলাম না । কোন ছেলের পক্ষেই এই আহবান মানা করা সম্ভব না । রাতের বেলা দুজন প্রবল আদিম খেয়াল ভেসে চললাম । আমাদের মাঝে সব কিছু বদলে গেল ।

সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন দেখলাম রিমি আগেই উঠে গেছে । এমন কি ওয়াশরুমেও নেই । বুঝলাম যে বাইরে গেছে । আমিও ওর খোজে বের হলাম । একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না সেটা বলবো না তবে ভালও লাগছিলো ।
রিমিকে পেলাম সৈকতেই । একটা বিচ চেয়ারে বসে আছে । আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই আমার দিকে তাকালো তারপর চোখ সরিয়ে নিল । আমি বললাম, কখন উঠেছিস?
-অনেক সকালে !
-আমাকে ডাকতি!
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে । তাই আর ডাকি নি । বস ।

ওর পাশে বসলাম । কিছু বলতে চাইলাম বটে তবে বলতে পারলাম না । পুরোটা দিন আমরা এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করলাম । তবে রাতে আমাদের মাঝে যা হয়েছে সেটা নিয়ে একটা কথাও বললাম না । তবে আমাদের মাঝে যে আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেছে সেটা আমরা দুজনই বেশ ভাল করেই বুঝতে পারলাম ।

ঢাকায় ফিরে এসে প্রথম কয়েকদিন রিমি আমার ধারে কাছেও এল না । না ফোন না মেসেজ কিছুই না । আমি কয়েকবার নক দেওয়ার পরেও ও উত্তর দিল না । সপ্তাহ দুয়েক এই ভাবে কাটলো । তারপর এক শুক্রবারে রিমি আমার বাসায় এসে হাজির ।

আমি তখন টিভি দেখছিলাম । সামনে কফির একটা কাপ রাখা । সকালে কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার । ওর কাছে দরজার চাবি ছিল । সেটা দিয়েই ভেতরে ঢুকলো । ছুটির দিনে আমি বেলা করে ঘুমাই এটা ভেবেছিল । আমি এতো সকালে উঠবো ভাবে নি । তবে আমার চোখের সাথে চোখ পড়াতে অপ্রস্তুত হল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর আমার সামনেই বসলো । আমি বললাম, ইগ্নোর কেন করছিস আমাকে শুনি?
রিমি কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, প্রথম কথা হচ্ছে এখন থেকে আমাকে তুই করে বলবে না আর ! আমার ভাল লাগে না ।
-ওকে । পরের কথাটা কী?
-ঐদিন আমাদের মাঝে যা হয়েছে ……
আমি একটু থেমে বললাম, হ্যা ঐদিন
আমিও কথা শেষ করলাম না । রিমি বলল, আমি আবারও করতে চাই !

আমি তখন সবে মাত্র কফিতে একটা চুমুক দিয়েছি রিমির কথা শুনে সেটা মুখ থেকে বের হয়ে এল । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম রিমির দিকে । ও যে এই কথা বলবে সেটা আমি বুঝতেই পারি নি । কোন মতে বললাম, কী বললি?

-এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো। যা বলেছি বেশ করেছি ।
-তুই আসলেই দেখি বদ হয়ে গেছিস !
-ইস আমার ভদ্র ছেলেরে ! ঐ দিন কী করেছিলে মনে নেই ?
-আমি করেছি ।
-অবশ্যই তুমি করেছো !

আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তবে কেন জানি হাসি চলে এল । তারপর বলল, এই কদিন কেন আসিস নি?
-জানি না । নিজের কাছে কেমন যেন লাগছিলো ।
রিমি একটু চুপ করে রইলো । তারপর বলল, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো যে আমি বুঝি তোমাকে …ব্যবহার করেছি ! আমি জানি আমি যদি ঐদিন নিজ থেকে এগিয়ে না আসতাম তাহলে এই রকম কিছুই হত না । আমি …

আমি এবার উঠে গিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম । তারপর ওর হাত ধরে বললাম, চল বিয়ে করে ফেলি । এবার সত্যি সত্যি !
রিমি একভাবে কেবল তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । আমি বললাম, তুমি কি ভাবিস আমি তোর মনের খবর জানি না । কেবল মায়ের কারণে তুই আমাকে কিছু বলিস না সেটাও আমি জানি ।
-চাচী কোন দিন আমাকে মেনে নেবে না ।
-সে চিন্তা তোর করতে হবে না । তুই বিয়ে করবি কিনা বল !

আমার বলে দিতে হল না । রিমির চোখ দেখেই মনে হচ্ছিলো যে ও আমার মুখ থেকে এই কথা শোনার জন্য কত অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা ছিল ।

ঐদিন বিকেলেই বিয়ে করে ফেললাম । বাসায় কিছুই জানাই নি। কিভাবে জানাবো সেটাও ভেবে দেখি নি । কোন এক সময়ে তারা জেনে যাবে এমনিতেও । তখন যা হবে ভেবে দেখা যাবে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 78

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →