ভালোবাসা ফিরে আসে

oputanvir
4.7
(67)

-তাহলে বিয়ের বাজারে আপনার দাম তাহলে অনেক বেশি !

তন্বী ভেবেছিলো এই টিটকারি মূলক কথা শুনে সামনে বসা ভদ্রলোক সম্ভবত রেগে যাবে । এমন করেই কথাটা বলেছি তন্বী । তার লক্ষ্য আসলে লোকটাকে খানিকটা রাগিয়ে দেওয়া যাতে নিজ থেকেই সে বিয়ের ব্যাপারে মানা করে দেয় । তাহলে ঝামেলা শেষ হয় ।

পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বাসার লোকজন তার জন্য পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছে । আজকেও সেইটার অংশ হিসাবে এই বিসিএস ক্যাডারের সাথে আজকে দেখা করতে এসেছে । ছেলেটার বয়স ৩৪ । একটু বেশি সময় তবে দেখতে শুনতে খারাপ না । আর সাথে যখন বিসিএস ক্যাডার যুক্ত তখন পাত্র হিসাবে সেই ছেলে খারাপ হতেই পারে না । এমনটা সব মেয়েদের বাবা মায়ের ধারণা । তন্বীর বাবা মায়েরও সেই একই ধারণা ।

তন্বীকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই আকাশ হেসে উঠলো বেশ শব্দ করে । হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকই বলেছেন। একেবারে জিনিসের দাম যেমন চড়া আমার মূল্যও তেমন চড়া ।

তারপর আবারও হাসতে লাগলো । সামনে কফির কাপটা ঠান্ডা হচ্ছে। তন্বী অন্য কিছু নিতে চেয়েছিলো তবে যখন ক্যাডার সাহেব দুটো কফির অর্ডার দিয়েই ফেলল তখন আর আলাদা ভাবে কিছু বলল না ।
তন্বী বলল, তা এতো দিন কেন বিয়ে করেন নি জানতে পারি?
-চাকরিই বছর খানেক ধরে । বয়স যখন শেষ তখন আসলে শেষবার চেষ্টা করেছিলাম । তখন ভাগ্য সহায় হল বলতে পারেন ।
-তাও বছর তিনেক আগের কথা । তাই না ?
-হ্যা সেটা বলতে পারেন ।
-তাহলে বিয়ে করেন নি কেন শুনি? মনের মত পাত্রী পাচ্ছেন না? নাকি যোগ্যপাত্রী মিলছে না !
এই প্রশ্নটার জবাব সাথে সাথেই দিল আকাশ । তন্বী খেয়াল করলো যে হাস্যজ্বল চেহারাটা যেন একটু মহিল হয়ে গেল । তবে সেটা কাটিয়ে উঠলো সাথে সাথেই । বলল, আমার আসলে কোন ডিমান্ড নেই । তবে আমার মায়ের চাহিদার কোন শেষ নেই । হাজার হোক তার ছেলে ক্যাডার । তার চাহিদা অনেক ।

তন্বীর কেন জানি মনে হল ছেলেটা মিথ্যা বলল । তন্বীর মনে একটা দ্বিধা কাজ করতে শুরু করলো তখনই । এই বেশি বয়সের ছেলেকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না । কিভাবে বিয়েটা না করা যায় সেটায় ভাবছিল সে । তবে আকাশের সাথে কথা বলে তন্বীর মনে হল যে এই ছেলেটাও আসলে বিয়ে করতে চায় না । যতই বাছাবাছি করুক না কেন এই দেশে বিসিএস ক্যাডারদের বিয়ে হতে সময় লাগে না । তাহলে এই ছেলে কেন বিয়ে করে নি !

তন্বী বলল, আমি আমাকে সত্যি কথাটা বলতে পারেন । আপনার মত আমিও আসলে বিয়ে করতে চাই না এখন !

আকাশ চট করে তাকালো তন্বীর দিকে । পাত্রী দেখতে এসেছে এমন কথা আকাশ শোনেনি একবারও । এর আগে যে মেয়েদের সে বাতিল করেছে তাদের বসাই বিয়েতে একেবারে এক পায়ে খাড়া ছিল । একটা মেয়ে সবে মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো সেও রাজি ছিল এক পায়ে । এই মেয়েটা অন্য রকম । এই মেয়েটাকে বলবে কিনা কথাটা ! বলাই যায় অবশ্য ! আজকের পরে আরতো দেখা হবে না এর সাথে । একটু জানলেই বা কি !

আকাশ বলল, আসলে আপনি ঠিকই ধরেছেন । একটু আগে বললেন না যে মনের মত পাত্রী পাচ্ছি না । আমি আসলেই মনের মত পাত্রী পাচ্ছি না । আরো ভাল করে বললে কোন পাবোও না ।
খানিকটা কৌতুহলী হয়ে তন্বী বলল, কোনদিন পাবেন না, এতো নিশ্চিত হয়ে কেন বলছেন?
একটু কষ্টের হাসি হেসে আকাশ বলল, নিশ্চিত করে বলছি কারণ আমার মনের মত মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে । সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে অনেক আগেই ।

তন্বীর হঠাৎ কেমন যেন একটা ধাক্কার মত লাগলো । বিশেষ এই লাইনটা বলতে গিয়ে আকাশের কন্ঠটা কেমন কেঁপে উঠলো । এই কাঁপনে যে বিষাদ ছিল সেটা তন্বীকে স্পর্শ করলো । আকাশ বলল, নিশি জানেন আমার সাথে পালিয়ে পর্যন্ত বিয়ে করতে চেয়েছিলো । বলেছিলো ওকে কিছু দিতে হবে না । আমি যা খাবো সেও তাই খাবে । দরকার হলে না খেয়ে থাকবে । আমার তখন কোন উপায় ছিল না । কত জনের হাতে পায়ে ধরেছি, কিছুই হয় নি । বাসায় মা বাবাকে কত রাজি করাতে চেয়েছি ! হয় নি কিছুই । তারপরেও সাহস করে বিয়ের দিন আমরা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম । তবে বাসায় ধরা পরে যায় ও । বিয়ে হয়ে যায় ওর !

এই টুকু বলেই আকাশ থামলো । সম্ভবত নিজেকে খানিকটা সামলে নিচ্ছে সে । তন্বী একেবারে বাক্য হারা হয়ে গেছে । বিশেষ করে এভাবে অকপটে ওর কাছে আকাশ সাহেব সব কিছু স্বীকার করে নিবে সেটা সে ভাবে নি । আকাশ কিছুটা বিরতির পরে বলল, এরপরে আসলে আমি আর কোন মেয়েকেই মনে জায়গা দিতে পারি নি । চেষ্টা করেও পারি নি । ভেবেছিলাম পুরুষ মানুষের মন, নতুন কাউকে কাছে নিয়ে এলে আগের জনকে ভুলে যাবো । এই ভেবে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । একজনের সাথে প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো বিয়ে । বিয়ের দিন সাতেক আগে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাত্রীপক্ষে মানা করে দিলাম । বাসায় বাবা মা খুব চেঁচামেচি করলো । জানেন সেদিন ভয়ংকর ভাবে আমি আমার বাবা মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম । আমার বেকার থাকা অবস্থায় তাদের দেওয়া প্রতিটা খোটা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম । তারপর থেকে তারা অবশ্য আর উচ্চবাচ্চ করে না । আমি যদি বিয়ের জন্য মানা করে দিই বলি যে পছন্দ হয় নি তারপর আর কোন কথা বলে না । নতুন কাউকে নিয়ে আসে !

হঠাৎ করেই যেন কথা ফুরিয়ে গেল দুজনের । কেউ কোন কথা বলল না কিছু সময় । তন্বী ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিলো কয়েকটা । তারপর বলল, এভাবেই চলবে?
-জানি না আসলে !
-একলা জীবন কি চলে বলুন?
-চলে যাবে আশা করি ।

তারপর একটু হেসে বলল, আপনি কেন বিয়ে করতে চাননা শুনি । পড়াশোনা শেষ । এখন তো বিয়ের বয়স !
-আমি আসলে নিজের পায়ে না দাড়িয়ে কিছু করতে চাই না । বরের কথায় ওঠা বসা আমার পক্ষে সম্ভব না ।

যাওয়ার সময় হল । যাওয়ার সময় আকাশ বলল, আই উইস ইউ বেস্ট অব লাক মিস তন্বী । আশা করি আমার মত জীবন যাতে আপনার না হয় !

তন্বী বসে রইলো । আকাশকে চলে যেতে দেখলো । আরেকটা কফির অর্ডার দিল সে । কফি যদিও তার পছন্দ না তারপরেও সেখানেই বসে কফিটা শেষ করলো তন্বী । ওর মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে । না চেনা সেই নিশিকে কেন জানি তন্বীর বড় ঈর্ষা হল । তন্বীর মনে একটা আফসোস জন্ম নিল যে, ইস! এমন ভাবে কেউ যদি তাকে ভালোবাসতো !

কফি শেষ করেও কিছু সময় ঘোরাঘুরি করলো ওর । বাসায় যখন ফিরলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । বাসায় মায়ের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো যে আকাশদের বাসা থেকে খবর চলে এসেছে । সে কিছুই বলল না । ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল । কেন জানি ওর মন খারাপ হল । অথচ সে মনে প্রাণে চেয়েছিল যাতে বিয়েটা না হোক । এখন সেই বিয়ে না হওয়াতেই তার মন খারাপ হচ্ছে ! বারবার মনে হতে লাগলো যে এমন একজনের সাথে বিয়ে হলে খুব কি খারাপ হত !
তবে প্রথম কয়েকদিন মন খারাপ রইলো বটে । এক সময়ে আকাশ নামের মানুষটা তন্বীর জীবন থেকে হারিয়ে গেল ।

তিন বছর তন্বী সেই সরকারি বিসিএস পাশ করে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকলো । প্রথম পোস্টিং সুখন পুরে । সেখানেই জয়েন করলো সে । সরকারি কোয়াটার দেওয়া হল । ওর কোয়াটারের ঠিক পাশেই টিএনওর বাসা । সেদিন বিকেলে নিজ থেকেই টিউএনওর বাসায় গিয়ে হাজির হল সে ।

জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই আকাশ নামের মানুষটার সাথে আবারও দেখা হয়ে সেখানে । আকাশ প্রথমে তাকে ঠিক চিনতে পারে নি । তবে কিছু সময় পরেই চিনতে পারলো । এবং তন্বী তখনই আবিস্কার করলো আকাশ তখনও বিয়ে করে নি । এই বাসায় সে তার বাবা মায়ের সাথে থাকে ।

-আপনি এখনও বিয়ে করেন নি?
আকাশ হেসে বলল এমনই তো হওয়ার কথা ছিল তাই না !

তন্বীর মনে সেই আফসোস টা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো । বারবার কেবল মনে হতে লাগলো যে ইস এমন করে কেউ যদি তাকে ভালোবাসতো ! একই জেলায় কর্মস্থল থাকার কারণে তন্বীর সাথে আকাশের দেখা হত প্রায়ই । কাছাকাছি বাসা হওয়ার জন্য আকাশের বাসায় যাওয়া হত । বিশেষ করে তন্বীর মা যখন তার কাছে থাকতে এল তখন আকাশের মায়ের সাথে তার বেশ ভাব জমে গেল। এবং তারা আবারও উদ্যোগী হল । এবং এইবার স্বয়ং তন্বীর নিজেরও ইচ্ছে রয়েছে সেখানে ।

তন্বীর মনের ভাব বুঝতে কারোই কষ্ট হল না । আকাশও বুঝতে পারলো । তখন জানতে চাইলো, আপনি কেন এমন টা চাচ্ছেন ? বিশেষ করে এমন একজন মানুষকে বিয়ে করতে চাইছেন যে কিনা কোন দিন আপনাকে ভালোবাসবে না । এটা জেনেও রাজি কেন হচ্ছেন?

তন্বী কী উত্তর দিবে সেটা নিজেই বুঝলো না । কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, ইটস ওকে !
-কী ইটস ওকে !
-ওকে যে আপনি ভালোবাসবেন না । কেবল আমাকে তো ভালোবাসতে দিন ! আপনার সাথে যখন আপার প্রথম দেখা হয় তখন আমার মনে হয়েছিলো যে এই ছেলেকে আমি কোন ভাবেই বিয়ে করবো না ।
-এটাই স্বাভাবিক ছিল ।
-কিন্তু আমি নিজের ভেতরে আবিস্কার করি যে আপনার প্রেমে পড়েছি আমি । তবুও আমি মেনেই নিয়েছিলাম । নিজের মনের সাথে সমঝতা করে নিয়েছিলাম । ঠিক যেমন করে আপনি নিজের জীবনের সাথে মানিয়ে নিয়েছেন তেমন করে । কিন্তু দেখুন দেখুন ৬৪টা জেলা রয়েছে আর আপনার এখানেই আমার পোস্টিং হতে হল ! আই ওয়ান্ট টু গিভ আস এ চান্স ! আমার কোন অভিযোগ থাকবে না যদি আপনি আমাকে ভালো না বাসেন । কিন্তু আমার মন বলছে যদি বিয়ে হয় তাহলে আমরা অখুশী হব না । ট্রাই করবেন প্লিজ?

আকাশ তন্বীর কন্ঠের আকুলতা টের পেল খুব ভাল ভাবেই । নিশি ঠিক একই ভাবেই ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো । দেখবে কি একবার চেষ্টা করে? নতুন করে কাউকে ভালোবাসা কি সম্ভব হবে !!

পরিশিষ্টঃ

আকাশ যখন বাসর ঘরে ঢুকলো তখন চারিদিকের কোলাহল থেকে গেছে । কোন আয়জন করবে করবে না করেও অনেক কিছু করা হয়েছে । টিএনওর বিয়ে হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে । একাবারে সরকারি বিয়ে যাকে বলে । জেলার ডিসি খবরটা শুনে তো খুবই খুশি । সে নিজেই সকল ব্যবস্থা করলো ।

বাসর ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল তন্বী খাটের উপর বসে রয়েছে । তবে মাথায় ঘোমটা নেই । মোবাইল টিপছে । ওকে ঢুকতে দেখেই মোবাইলটা একপাশে সরিয়ে রাখলো । আকাশ কী যে বলবে খুজে পেল । এমন দিন সে আসবে তার জীবনে সে কোন দিন ভাবে নি । অথচ এসেছে । অন্য একটা মেয়ের সাথে যে কিনা তাকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ছিল ।
এখনও তন্বীর চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে আকাশ । এই ভালোবাসা সে চিনতে পারে ! কিন্তু সে কি পারবে একই ভাবে ভালোবাসতে ! নয়তো মেয়েটার সাথে তো প্রতারণা করা হবে !

আকাশ খাটের উপর বসলো । তারপর বলল, খুব ধকল গেল সারা দিনে !

তন্বী হেসে ফেলল । তারপর বলল বউকে অন্য কথা বল । বল যে তোমাকে দেখতে আজকে সুন্দর লাগছে ।
আকাশ হাসলো । বলল, তুমি দেখতে এমনই সুন্দর । প্রতিদিনই সুন্দর লাগে !
-যাক এটা শুনে তো ভাল লাগলো !

এরপর তন্বী নিজ থেকেই আকাশের কাছে এল । তারপর ওর হাত ধরে বলল, লেটস ট্রাই ইট ! কেমন !
-ওকে !

তন্বী আর আকাশের জীবনের চলার পথটা আবারও এক সাথে এসে মিশে গেছে । একসাথে তাদের পথ চলা হবে আরও অনেকটা দুরে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 67

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →