বিয়ের হাতকড়া

oputanvir
4.7
(88)

বুদ্ধিটা আমাকে নীলুই দিল । প্রথমে আমি নীলুর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে নীলুর মনে কোন কুবুদ্ধি আছে কিনা । কিন্তু যখন সত্যি সত্যিই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখলাম তখন মনে হল বুদ্ধিটা একেবারে খারাপ সে দেয় নি । নীলু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কই টাকা দাও ।
আমি বললাম, টাকা কিসের?
-বারে এতো চমৎকার বুদ্ধি দিলাম, তোমাকে মায়ের হাত থেকে বাঁচার একটা চমৎকার বুদ্ধি দিলাম আর তুমি আমাকে টাকা দিবা না ?
কেন জানি পকেট থেকে একটা ৫০ টাকার নোট বের করে দিলাম । মনে হল বুদ্ধিটা কাজে দিলেও দিতে পারে ।
নীলু নোটটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর এক ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে দ্রুত গতিতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল আমি টাকা টা আবারও আমার পকেটে চালান করে দেওয়ার আগেই ।

আমি বুদ্ধিটা নিয়ে আরও একটু ভাবতে লাগলাম । কাজ হতে পারে । আর যদি নাও হয় তাহলেও কোন সমস্যা দেখি না । মাকে বলার মত আমার হাতে আসলে তেমন কিছুই নেই । এটা দিয়ে অন্তত কিছু একটা অযুহাত তো বের করা যাবে ।

ঘটনা আসলে তেমন কিছু না । ছেলে বড় হলে সব বাবা মায়ের মাথায় যে ভুত চাঁপে আমার বাবা মায়ের মাথাতেও ঠিক তেমন ভুত চেপে বসে আছে । বিশেষ করে আমার মায়ের মাথায় । ছেলেকে যে কোন ভাবেই বিয়ে তাদের দিতেই হবে । দুনিয়ার সবাই বিয়ে করে ফেলছে আমি কেন বিয়ে করছি না, এই চিন্তাতে তাদের কারো ঘুম আসছে না ।

সত্যি বলতে আমার বিয়ে ভীতি আছে । ভীতিটা আমার এমনি এমনি হয় নি । আমার বন্ধুদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে কেবল আমি ছাড়া । এর ভেতরে কয়েক জনের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক । তাদের বিবাহিত জীবনের আমি খুব কাছ থেকে । তাছাড়া বিয়ের আগে তাদের জীবন আর বিয়ের পরে তাদের সেই জীবন আমি মিলিয়ে যতবারই দেখি ততবারই মনে হয় আমার বিয়ে হলেও আমার অবস্থা ঠিক এই রকম হবে । আমি এটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না । কোন ভাবেই না । তাই যে কোন ভাবেই আমি বিয়েটা ঠেকাতে চাই । বিয়ে করতে চাই না । কিন্তু কে শোনা কার কথা । আমার মা ঠিক পণ করে বসে আছেন, আমাকে তিনি বিয়ে এবার দিয়েই ছাড়বেন । কোন ক্ষমা নেই, কোন নিস্তার নেই । আমি এতোদিন কোন যুতসই কারণ খুজে পাই নি ।
এই বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি । মাকে এই বলে তখন বুঝিয়েছি যে প্রাইভেট চাকরি আমার ভাল লাগছে না । আমি এবার বিসিএসের জন্য চেষ্টা করবো । সরকারি একটা চাকরি করতে হবে । তারপর একটা ভাল দেখে বিয়ে করবো। এই বলে এতোদিন মাকে আমি ঠেকিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে খুব বেশি দিন এই অযুহাতে কাজ হবে না । চাকরি না হলেও সে আমাকে বিয়ে এবার দিয়েই ছাড়বে !

একবার বন্ধু জুলকাইণ খুব ভয়ানক একটা বুদ্ধি দিয়েছিলো । যদি সেই কথা মাকে বলতাম তাহলে নিশ্চিত আমার মা হার্ট ফেইল করে মারা যেত । সেই কারণ বলা হয় নি কিন্তু এবার মনে হল যে পেয়েছি । এমন একটা বুদ্ধি যেখানে সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙ্গবে না ।

মীরা আমাদের এলাকাতেই থাকি । তাকে অনেক দিন থেকেই চিনি তবে কোন দিন কথা বলেছি কিনা মনে পড়ছে না । যাওয়া আসার সময় দেখা হয়েছে বহুবার । আমি যে এলাকাতে থাকি এটা বেশ সম্ভ্রান্ত একটা এলাকা । সমাজের সব উচু শ্রেণীদের বাস এখানে । আবার বাবাও তেমনই একজন । পেশায় তিনি একজন আইনজীবি । বড় ভাইও আইন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন । এডিশনাল জজ সে । সিলেটে থাকে বউ নিয়ে । আশে পাশে যারা আছে তারাও একই রকম । কেউ আমলা কেউ বা পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মচারি । মীরার বাবা পুলিশের ডিআইজি । আর মীরা নিজেও পুলিশ । বছর দুয়েক আগে বিসিএস দিয়ে এএসপি হয়ে ঢুকেছে । মেয়েটা লম্বায় প্রায় আমার সমান । দেখতে শুনতে বেশ ।
যাই হোক কথা বার্তা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে । আসল কথায় আসি । নীলু আমাকে বুদ্ধি দিল যে আমি যেন মা কে বলি যে আমি এই মীরাকে পছন্দ করি । মীরা কে পছন্দ করি বলে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিসিএসের জন্য পড়াশুনা করছি । মীরার মত মেয়েকে বিয়ে করতে হল ওর সমান সমানে তো হতে হবে । আমার আগের প্রাইভেট চাকরিতে কোন কাজ হত না । মীরার বাবা কোন ভাবেই রাজি হতেন না ।
নীলু বুদ্ধি দিল যে আমি মাকে মীরার কথা বলি । মা হয়তো চেষ্টা করবে মীরাকে রাজি করানোর কিন্তু সে কোন ভাবেই রাজি হবে না। একে তো আমি এখন বেকার । কোন কাজ কর্ম করি না । দ্বিতীয় তো মীরার নাকি একজন ভালোবাসার মানুষ আছে । সেও পুলিশ । নীলুর কথায় সত্য আছে সম্ভবত । একদিন আমি নিজে দেখেছি । আমাদের আর ওদের বাসা ঠিক কাছাকাছিই । একদিন রাতের বেলা আমি বাসায় ফিরছিলাম তখন মীরাকে দেখলাম ফুটপাথের উপরে বসে একটা ছেলের সাথে গল্প করছে হেসে হেসে । তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । ছেলেটার পরনে পোশাক না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হল না যে ছেলেটাও মীরার মত পুলিশে চাকরি করে ।
তাহলে ব্যাপারটা এমন হবে যে আমি বলবো যে আমি মীরার জন্য আসলে কাউকে বিয়ে করছি না আর মা কোন ভাবেই মীরাকে রাজি করাতে পারবে না । ব্যস ঝামেলা শেষ । অন্তত বছর খানেকের জন্য আমি মুক্তি পাবো । পরের টা পরে আবার চিন্তা করা যাবে ।

মা কে বলতেই মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন । মা এলাকার সব মেয়েকেই চিনেন খুব ভাল করেই । কোন মেয়েটা কেমন আর কোন মেয়েটা আমার জন্য ভাল হবে এসবের জন্য তিনি খোজ খবর রাখতেন সব । সুতরাং তিনি নিজেও ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছেন যে মীরা নামের মেয়েটা কোন ভাবেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না ।

কয়েক দিন কেটে গেল একেবারে শান্তি মত । মনের আনন্দে আমি ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । সারাদিন বই পড়ি নয়তো মুভি দেখি । সন্ধ্যা হলে বিবাহিত বন্ধুদের দুঃখের গল্প শুনি । আর আমি যে বিয়ে করি নি সেটার জন্য নিজেকে বড় বুদ্ধিমান মনে হয় । ঠিক এই সময়ে ঘটলো দুর্ঘটনা ।

আমি সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরছি । আমাদের এলাকার রাস্তাটা সব সময় ফাঁকাই থাকে বলা চলে । মাঝে মাঝে একটা দুইটা গাড়ি চলে যায় ভুসভাস করে । তাছাড়া সব সময় শান্ত পরিবেশ । সন্ধ্যার সময়ও তাই । আমি হেটে হেটে বাসার দিকে আসছি ঠিক এমন সময় আমার চোখ গেল রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা একটা সাদা রংয়ের পুলিশের গাড়ির দিকে । আমি কাছে যেতে যেতেই গাড়ির গেট খুলে গেল এবং সেখান থেকে স্বয়ং মীরাকে বের হতে দেখলাম । পুলিশের পোশাক পরা রয়েছে । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর শান্ত কন্ঠে বলল, আপনার কী সমস্যা?
আমি খানিকটা ভড়কে গিয়েছিলাম বটে । এভাবে মীরা যে আমার সামনে এসে হাজির হবে সেটা আমি বুঝতে পারি নি । কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, মানে?
-মানে বললাম আপনার কী সমস্যা?
-আমার তো কোন সমস্যা নেই।
-তাই না? আপনাকে তো ভাল ছেলে হিসাবে জানি !
-আমি….
-ভাল হয়ে যান । বুঝেছেন । একদম ভাল হয়ে যান ।

মীরা আমাকে রেখে এবার গাড়ি উঠে বসলো । গাড়ি সামনের দিকে রওয়ানা দিল ! আমি সত্যিই কিছু বুঝলাম না। কী হল ? আমার সাথে মীরা এমন কেন করলো?
তখন আমার মাথায় চিন্তা এল ! এক হতে পারে যে মীরাদের বাসায় মা গিয়েছেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । কোন ভাবে রাজী করাতে চেয়েছেন কিন্তু মীরা রাজি হয় নি । হবে না এটা আমি জানতাম । মা নিশ্চয়ই আমার সেই গল্পও বলেছেন কোন ভাবে !
আমি চিন্তিত মুখে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম । কেন জানি মনে হচ্ছে মীরার সাথে আমার আবারও দেখা হবে ।
মা কে কিছু বললাম না মীরার ব্যাপারে তবে নীলুকে ঠিকই বললাম । সব শুনে নীলু বলল, ভাইয়া একটু সাবধানে থাকিস !
আমি বললাম, আমি কেন সাবধানে থাকবো?
নীলু হেসে বলল, বারে পুলিশ এবার তো পেছনে লেগেছে । পুলিশকে ইভ টিজিং করিস?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । বললাম, আমি ইভ টিজিং করলাম কিভাবে?
নীলু বলল, এটাও ওয়ান কাউন্ড অব ইভ টিজিংই বলতে পারিস । একটা মেয়ে যে কাজ পছন্দ করছে না তার সামনে সেই কাজ করা ।

নীলু আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল । আমি চিন্তিত মুখে নিজের ঘরে বসে রইলাম । সত্যিই তো মীরা যদি এমন কিছু মনে করে তাহলে? এবং পুলিশের হয়রানি বড় ঝামেলার ব্যাপার । আমার বাবা যেহেতু একজন এডভোকেট আমি এই ব্যাপার গুলো জানি বেশ ভাল করেই । আমি মনে মনে ঠিক করলাম যে সামনের কয়দিন আমি বাসা থেকে বের হব না । বাসা থেকে না বের হলে মীরার সামনে পড়তে হবে না ।

কিন্তু কপালে থাকলে সেটা এড়ানো যায় না । মীরার সাথে আমার আবারও দেখা হয়ে গেল । সারাদিন বাসায় থাকার পরে আমি রাতে একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছি । রাত তখন এগারোটা হবে । এই সময়ে মীরার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে । এলাকার রাস্তা দিয়েই হাটছি । আগেই বলেছি আমাদের এলাকাটা একটু শান্ত চুপচাপ । এলাকার ভেতরে দোকান পাট নেই। যে কোন কিছুর জন্য আমাদের এলাকার থেকে একটু দুরে যেতে হয় । আমি দোকানে গিয়ে এক কাপ চা খেলাম । তারপর আবার যখন ফিরে আসছি তখন পরলাম মীরার সামনে ।
আজকে অবশ্য মীরা পুলিশের পোশাকে নেই । একটা টাইট জিন্স পরে আছে সাথে সাদা টিশার্ট । টিশার্টের হাতার এক কোনে লেখা রয়েছে পুলিশ । কোমরে ঠিকই পিস্তল রয়েছে । আজকেও সে গাড়ি থেকেই নামলো । আমার কেন জানি মনে হল সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো । যেন সে জানতো আমি এখন এই পথ দিয়েই যাবো । মনের ভেতরে ক্ষীণ সন্দেহ জাগলো যে মীরা আমার পেছনে যেন ফেউ লাগিয়েছে । আমি কোথায় যাই বা না যাই সেটা সে খোজ রাখা শুরু করেছে ।
আমি সামনে যেতেই সে আমাকে থামালো । তারপর আমার দিকে শান্ত কন্ঠে বলল, এতো রাতে বাইরে কী?
-না মানে চা খেতে বের হয়েছিলাম ।
-চা খেতে? বাসায় চা বানায় না? ভাল ছেলেরা এতো রাতে বাইরে বের হয়না । চা খেতে নাকি অন্য কিছু খেতে বের হয়েছেন?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । বললাম, অ-অন্য কিছু মানে?
-ইদানীং এই এলাকাতে গাঁজার সাপ্লাই বেড়েছে ।
-আআমি সিগারেট পর্যন্ত খাই না ।
-আচ্ছা তাই নাকি! দেখি কাছে আসুন দেখি ।

এই বলে মীরা আমার দিকে ঝুকে এল । একেবারে কাছাকাছি । আমি ওর শরীরের একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম । এটা কেবল মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ না । মেয়েদের শরীরে একটা আলাদা মোহনীয় গন্ধ থাকে । আমি এর আগে কোন দিন নিজ থেকে সেটা অনুভব করি নি । বইপত্রে পড়েছি কেবল । আজকে সে বুঝতে পারলাম । আসলেই এই গন্ধটা অন্য রকম । মীরা আমার কাছে এসে নাক দিয়ে কিছু যেন শুকলো । তারপর বলল, হুম কিছু খান নি । শুনেন কিছু খাবেন না এই সব । এখন কিন্তু এই ল খুব কড়া । একবার ধরা পড়লে সোজা ৭ বছর জেল । কেউ বাঁচাতে পারবে না । আপনার এডভোকেট বাবাও না । যান যান বাসায় যান । রাতের বেলা বাইরে বের হবেন না । সময় বড় খারাপ !

আমি দ্রুত পায়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । একবারও পেছনে না তাকিয়ে । আমার কেন জানি মনে হল মীরা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে একভাবে । তারপর থেকে এই ঝামেলা একের পর এক আসতেই লাগলো । কিভাবে কিভাবে জানি মীরা টের পেয়ে যেত আমি কোথায় যাই কি করি । আমাকে কতবার যে চেক করা হল সেটা আমি নিজেও জানি না । একবার মনে হল ওকে ডেকে সব কিছু বলে দিই । আর সরি বলি । আমার কাছে ওকে খানিকটা বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে এটার জন্য ওকে সরি বলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে হল । আর অনুরোধ করি যাতে আমার সাথে এমন আচরণ আর না করে । এমনই যখন চিন্তা ভাবনা তখন আসল বিপদ এসে হাজির হল !

মাস খানেক পরের কথা । বিকেলে মা বলল যেন আমি আজকে বাইরে না যাই । যদিও আমি বাইরে যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছি বললেই চলে । সারাদিন বাসাতেই থাকি ।
তবুও মায়ের এমন আলাদা ভাবে বাইরে না যেতে বলার কারণ জানতে মন চাইলো । আমি বললাম, কেন কোন কাজ আছে?
-হ্যা । আজকে আমরা মীরাকে আংটি পরাতে যাবো !

আমার প্রথমে মনে হল যেন আমি ঠিক মত মায়ের কথাটা শুনতে পেলাম না । চোখ কপালে তুলে বললাম, কী বললে? কী করতে যাবো ?
মা শান্ত কন্ঠে বলল, মীরাকে আংটি পরাতে যাবো?

আমি কেবল চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে । মীরা আংটি পরাতে যাবে মানে টা কি? মীরা রাজি হয়ে গেছে বিয়ের জন্য?
কিভাবে রাজি হল?
আর কেনই বা রাজি হল?
কেন রাজি হবে?
না না এসব হবে না । এমন তো মোটেও হওয়ার কথা না ।
আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল, দেখ তুমি তোমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করতে চেয়েছো সেটাই হচ্ছে এখন কোন অযুহাত দিবে না ।
-কিন্তু মা……
আমি কিছু বলতে গেলাম কিন্তু কি যে বলবো কিছুই খুজে পেলাম না । মা বলল, আমি এখন কোন কিন্তু শুনবো না । আজকে যাবে মানে যাবে । দরকার হলে পুলিশ দিয়ে তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে ।

মা আমাকে সব সময় তুই করেই বলে । কিন্তু আজকে যখন তুমি করে বলছে তার মানে হচ্ছে অবস্থা বেগতিক । আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম যে আপাতত মীরাদের বাসায় যাওয়া যাক । মায়ের মেজাজ অত্যাধিক গরম হয়ে যাবে যদি এখন না যাই । আংটি পরানো মানেই তো আর বিয়ে হয়ে যাওয়া না । মীরাকে যতদুর সম্ভব ওর বাবা মাই রাজি করিয়েছে কোন ভাবে । মীরার সাথে কথা বলে দুজন মিলে কোন কিছু একটা বুদ্ধি বের করা যাবে ।

বিকেল বেলা তৈরি হয়ে আমি বাবা আর মা হাজির হলাম মীরাদের বাসায় । গিয়ে দেখি নীলু আগে থেকে মীরাদের বাসাতেই বসে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টুমির হাসি দিল । আমি একটু অবাক হলাম । তবে আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে আধা ঘন্টার মাঝে আমার বড় ভাই আর ভাবী এসে হাজির হল মীরাদের বাসায় । দেখলাম ওদের কয়েকজন আত্মীয়ও এসে হাজির হল । এবং সবার মাঝে আমি সেই ছেলেটাকে দেখতে পেলাম যাকে আমি মীরার সাথে ফুটপাতে বসে গল্প করতে দেখেছিলাম । আমার কেমন যেন মনে হতে লাগলো । এই ছেলেটা এখানে কেন?

আমার চোখ মীরাকে খুজতে শুরু করলো । কিন্তু ওকে পেলাম না । আংটি পরানোর আগে ওর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত কিন্তু আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল না । ও এলে একেবারে শেষ মুহুর্তে । ওকে দেখে আমি একটু চমকেই গেলাম । মীরাকে একেবারে অন্য রকম লাগছে । এতোদিন ওকে আমি দেখেছি পুলিশের পোশাকে নয়তো জিন্স টিশার্টে । আজকে ও পরেছে একটা শাড়ি । নীল রংয়ের বেনারশি । মুখে খুবই হালকা মেকাপ দেওয়া । কেবল ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দেওয়া । আমার দিকে চোখাচোখি হল এবং আমি আরও একটু দ্বিধান্বিত হয়ে উঠলাম । মীরাকে দেখে মোটেই আমার মনে হল না যে ওর মন মেজাজ কোন কারণে খারাপ । বরং ওকে যেন আনন্দিত মনে হল ।
কেন মনে হবে?

কিন্তু তখনও আমার অবাক হওয়ার ব্যাপারটা বাকি ছিল । আরও আধা ঘন্টা পরে এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেবকে যখন বাসায় ঢুকতে দেখলাম তখন আমার গলার পানি শুকিয়ে গেল । বারবার মনে হল যে এই লোক এখানে কেন আসবে? এখানে আসার কোন কারণ আছে কি? আংটি পরানোর জন্য তো আর হুজুরের দরকার নেই ! নাকি আছে? দোয়ার জন্য কি?
মনের ভেতর থেকে আমি সত্য কথাটা অস্বীকার করতে চাইলাম কিন্তু আমি খুব ভাল করেই জানি যে এটা কোন ভাবেই সত্য না । যে ভয়টা আমি এতোদিন পেয়ে এসেছি সেটাই হতে চলেছে ! এবং সত্যিই তাই হল ।

আংটি পরানোর সময় মীরাকে আমি আরও ভাল করে দেখলাম । সত্যিই বলতে কী ওর মুখ দেখে মনে হল ও খুব বেশি আনন্দিত । ওকে কোন ভাবেই আমার দুঃখিত মনে হল না কিংবা মনে হল না যে বাসার লোকজন ওকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে । আংটিটা পরানোর সময় ওর চোখের দিকে আমার চোখ গেল । সেই চোখের দিকে তাকিয়েই আমার মনে হল সত্যিই সত্যিই আমি মহা বিপদে পড়তে যাচ্ছি ।
আংটি পরানোর শেষ হতেই মীরা আমার মায়ের উদ্দেশ্য করে বলল, আন্টি নিলয়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে আমাকে আংটি পরাচ্ছে না যেন গলাতে শিকল পরছে ।
মীরার কথা শুনে রুমের সবাই হেসে ফেলল । মীরা বলল, আমার মনে হচ্ছে যে এখন থেকে বের হতে পারলাম আপনার ছেলে দৌড় দিবে । তাই তাকে সেই সুযোগ আমি দেব না ঠিক করেছি ।
আমার মুখ দিয়ে তখন একটা কথা বের হল না । আমি কেবল অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইলাম । মীরা বলল, আমি চাই আজকেই আমাদের বিয়ে হয়ে যাক !

-আরে শুভ কাজে দেরি করতে নেই । আজই হোক।

কথাটা আর কেউ না বলল আমার বাবা । দেখলাম সবাই তাতে সাইও দিল ।

আমি তখন চিৎকার করে বলতে চাইলাম যে আমি বিয়ে করতে চাই না । মোটেও চাই না । কিন্তু আমি কেবল দরজার দিকে তাকিয়ে তাকাতে থাকলাম । কেবলই মনে হল যে এখনই আমাকে এখান থেকে দৌড় দিতে হবে ।
একবার এখান থেকে বের হতে পারলে আমার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না মোটেও । পরে যা হওয়ার হবে ।
তখনই ক্লিক আওয়াজ পেলাম । আমার চোখ দরজার দিকে থাকার কারণে আমি মীরার দিকে খেয়াল দেই নি । ও আমার পাশেই ছিল । কখন ও নিজের হাতের সাথে আমার হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকে ফেলেছে আমি টেরও পেলাম না । আমার অবাক হতে দেখে মীরা বলল, পালানোর কথা ভাবছো? মানুষের চোখ দেখলেই আমি বুঝতে পারি তাদের মনে কী চলছে । পালিয়েও লাভ হত না । বাইরে আমি পুলিশ মোতায়েন করেই রেখেছি ।

ঘর জুড়ে হাসির রোল পড়লো । মীরা বলল, তোমাকে এতো সহজে ছাড়ছি না আমি । বুঝেছো? এখন চুপচাপ বিয়ে হ্যা বল । নয়তো এইভাবে থাকতে হবে আমার সাথে । যত সময় না কবুল বলবে তত সময় আমরা এভাবে আটকা থাকবো ।

আমি বুঝে গেলাম যে আমার পালানোর সব পথ এবার বন্ধ !

বিয়ে হয়ে গেল । বিয়ের পর ঠিক হল আজকে বাসর রাতটা মীরাদের বাসাতেই হবে । মীরার সাথে এখনও আমার হ্যান্ডকাফ দিয়ে যুক্ত হয়ে আছি । আমি একবার বললাম যে আমার হাত খুলে দাও । মীরা বলল, তোমার কোন ভরসা নেই । এখনও পালিয়ে যেতে পারো ।
সত্যিই বলতে পালানোর ব্যাপারটা মনের ভেতর থেকে তখনও যাই নি । বারবার মনে হচ্ছে পালাতে হবে !

রাতে খাওয়া দাওয়া হল বড় ঝামেলা করেই । মীরা কিছুতেই হ্যান্ডকাফ টা খুললো না । আমার বাঁ হাত আটকানো ছিল বিধায় আমার খেতে খুব একটা সমস্যা হল না । মীরার ডান হাত আটকে থাকার কারণে ও কিছু খেতে পারলো না । আমার পাশে চুপ করে বসে ছিল । ও চুপ করে বসে আছে দেখে আমার মা আমাকে বলল আমি যেন মীরাকে খাইয়ে দিই । হাতে তুলে খাইতে দিলে নাকি মায়া মহব্বত বাড়বে !
আমি তখন খানিকটা ঘোরের ভেতরে চলে গেছি । যা হয়েছে তা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না । মীরা খাইয়েও দিলাম নিজ হাতে । মীরা খুব আনন্দ করে সেটা খেল । মেয়েটার আজকে বিয়ে হয়েছে । বিয়ের দিন মেয়েরা নাকি লজ্জা পায় অথচ মীরার মাঝে তেমন কোন ভাবই দেখলাম না । সে এমন ভাব করে আছে যেন বিয়েটা অতি স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । এমন বিয়ে সে দিনে দু একটা করে প্রতিদিন ।

যখন আমরা বাসর রাতে ঢুকলাম তখন আমাকে আরও একটু অবাক হতে হল । বাসর ঘরটা খুব চমৎকার করে সাজানো । আমি এবার মীরার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সব কিছু প্লান করেই রেখেছিলে, না?
মীরা হাসলো, এতো পরে বুঝলে?
-নীলু তোমার সাথে মিলে ছিলো?

মীরা হাসলো । আমি বললাম, নীলুকে আমি হাতের কাছে পাই একবার ! তারপর ওকে মজা দেখাবো ।
মীরা বলল, খবরদার । নীলু এখন আমার প্রোটেকশনে আছে । ওকে কোন কিছু করা যাবে না । বুঝেছো ?

আমি মীরার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এখনও আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না মীরা আমাকে কেন বিয়ে করলো । কোন কারণ আছে কি?
এতো সময় পরে মীরা আমার হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিলো । আমি হাত টা একটু ডলতে ডলতে বললাম, একটা প্রশ্নের জবাব দিবে?
-বল । তোমার কথার জবাব তো দিতেই হবে।
-কাজটা কেন করলে তুমি? তাও আমার মত একজনকে ! মানে তোমার তুলনাতে আমি তো কিছুই না !

মীরা হাসলো । তারপর বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে আমার মুখোমুখি দাড়ালো । আমার চোখে চোখ রেখে বলল, নিলয়, মানুষের মন বড় অদ্ভুত জিনিস । বুঝেছ! যাকে একবার ভাললাগে তার থেকে কোন ভাবেই মন উঠিয়ে ফেলা যায় না । তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন থেকেই পছন্দ করি । কেন সেদিন তোমাকে পছন্দ করেছিলাম আমি জানি না । আমি আজও জানি না কেন! কেবল আমার মনে আছে আমি সেদিন বৃষ্টির সময় বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম । তোমাকে দেখলাম রাস্তার উপরে তুমি খালি পায়ে আস্তে আস্তে হাটছো আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন বলছো? সেই দৃশ্য আমি কোন দিন ভুলতে পারি নি । আমার সেদিনই মনে হয়েছিলো এই ছেলের সাথে আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে ! কলেজ তারপর বিশ্ববিদ্যালয় এরপর চাকরি, কত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হল কিন্তু তোমাকে ছাড়া কোন ভাবেই আমি সেই দৃশ্যে অন্য কাউকে কোন দিন ভাবতেই পারি নি ।

মীরা আমার একদম সামনে দাড়িয়ে ছিল । ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল মেয়েটা কত খানি আবেগ নিয়ে কথা গুলো বলছে ! এতোটা তীব্র আবেক নিয়ে কেউ এর আগে আমাকে নিয়ে কথা বলে নি । এতো কাছে মীরা দাড়িয়ে আছে । ওর নিশ্বাসের আওয়াজ আমি পাচ্ছি । সেদিনের সেই মোহনীয় গন্ধটাও আমি পাচ্ছি নাকে ! আমার পুরো শরীর যেন একটু কেঁপে উঠলো । তারপর আমার কি যে হল আমি ওর কপালে একটা চুমু খেলাম তখনই । দেখলাম ও চোখ বন্ধ করে ফেলেছে । আমি নিজের ভেতরে একটু কাঁপন অনুভব করলাম । জীবনে এই প্রথম আমি কোন নারীর এতো কাছে চলে এসেছি ।
এরপর ঠোঁট দিয়ে ওর নাকে আরও মৃদু ভাবে আরেকটা চুমু খেলাম ।
সব শেষে ওর ঠোঁটে !

যখন আমি চোখ খুলে তাকিয়েছি তখন দেখি মীরার চোখ বেঁয়ে পানি পড়ছে । তবে সেটা অবশ্যই দুঃখের অশ্রু নয় । মানুষের মনে যখন নির্মল আনন্দ এসে জমা হয় তখন চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি বের হয়ে আছে । এই অশ্রুর নাম আনন্দ অশ্রু !

বিয়ে ভীতি যে আমার কেটে গেছে সেটা আমি মোটেও বলবো না । আমি নিশ্চিত জানি যে আমার অবস্থাও আমার সেই বন্ধুদের মত হবে । আর বউ যখন পুলিশ তখন অবস্থা তো আরও খারাপ হবে । তবে মীরার এই তীব্র আবং আর আনন্দ অশ্রুর কাছে সে সব সম্ভবত অনেক ছোট হয়ে যাবে ! দেখা যাক সামনে কপালে আমার কী আছে । সকলের দোয়া প্রার্থী !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 88

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “বিয়ের হাতকড়া”

  1. ভাই এইটা সেকেন্ড পার্ট চাই!
    “মিরার সংসার”

Comments are closed.