পিরি রেইসের ম্যাপ কি এলিয়েন বা প্রাচীন কোন উন্নত সভ্যতার ইঙ্গিত দেয়?

oputanvir
4
(5)

একজন সুইচ লেখক এরিক ফন দানিকেন । দানিকেনের দাবী হচ্ছে মানব জাতি নয়, মানব জাতি যাদের উপাসনা করে তারা আসলে এসেছিলো অন্য গ্রহ থেকে । এই নিয়ে লেখক দানিকেন একটি বই লেখেন । বইটির নাম Erinnerungen an die Zukunft: Ungelöste Rätsel der Vergangenheit। ইংরেজি নাম Chariots of the Gods? Unsolved Mysteries of the Past. বইটা ১৯৬৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় জার্মানিতে এবং পরবর্তিতে মোট ৩৭ টি ভাষায় অনুদিত হয় !
এই বইয়ে এলিয়েন কিংবা ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ নয় বরং লেখক কেবল কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন । যেমন শুরুতেই বলেছেন আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়া প্রাণের অস্তিত্ব থাকার জন্য অনুকুল । সূর্যয়ের মত এই রকম নক্ষত্রের কত যে আছে তার কোন হিসাব নেই । তাহলে সেই সব নক্ষত্রের চারিদিকে ঘুর্নায়মান কোন একটা গ্রহ কি থাকা খুব অসম্ভব যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে?

আমার আজকের এই পোস্ট সেই সমস্ত প্রশ্ন বিপরীতে একটা রহস্য নিয়ে । রহস্যের ব্যাখ্যা অনেক আছে । এলিয়েন কিংবা ভিন গ্রহের প্রাণীরা এই পৃথিবীতে এসেছিলো কিনা সেই টুকুও এক পাশে সরিয়ে রাখলেও বইটাতে যতগুলো রহস্যের কথা বলা আছে সেই সম্পর্কেও জানাটা একটা মজার ব্যাপার হবে । তেমন একটা রহস্য হচ্ছে পিরি রেইসের ম্যাপ । কলাম্বাস আমেরিকা আবিস্কারের মাত্র ২০ বছরের মধ্য, কোন প্রকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গননা যন্ত্র ছাড়া পিরি রেইস কিভাবে এতো নিখুত ভাবে একটা ম্যাপ আঁকতে সক্ষম হয়েছিলো সেটা একটা বিরাট রহস্য। এই ম্যাপের সব থেকে বড় রহস্য হচ্ছে ম্যাপে এন্টার্কটিকার আস্তিত্ব দেখা গিয়েছিলো । এই ম্যাপটা আঁকা হয়েছিলো এন্টার্কটিকা আবিস্কারেরও প্রায় ৩০০ বছর আগে । এবং সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে ম্যাপে যে এন্টার্কটিকাকে দেখানো হয়েছে সেটা ছিল বরফ ছাড়া । অর্থাৎ পিরি কেবল মাত্র মাটির এরিয়া টুকু তার ম্যাপে দেখিয়েছিলেন ।

পিরি রেইসের আসল নাম আহমেদ মুহিদ্দীন পিরি । তিনি আনুমানিক ১৪৬৫ সালের দিকে ইস্তানবুলের গ্যালিপোলিতে জন্মগ্রহন করেন । ১৬ বছর থেকে সে তার চাচা কামাল রেইসের সাথে সমুদ্র যাত্রা শুরু করেন । চাচা কামাল(কিমাল) রেইস তখন অটোমান সেনাতে নাবিক হিসাবে কর্মরত । চাচার সাথে নাবিক হিসাব কাজ শুরু করেন, তারপর যোগদান করেন অটোমান নৈসেনাতে। চাচার সাথে অনেক যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহন করে। চাচার মৃত্যুর পরে তিনি রেইস নামেই পরিচিত হন বেশি। পিরি অটোমান সম্রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ এডমিরাল হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন । তার কর্ম জীবনের প্রায় পুরোটাই সে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ান এবং সেই জ্ঞান তিনি কাজে লাগান নানান মাত্রচিত্র আঁকার কাজে । (পিরি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটা পড়তে পারেন) তেমনই একটা ম্যাপ নিয়ে আজকের আলোচনা ।

১৯২৯ সালে তুরস্কের ইস্তানবুলের তোপকালী প্রাসাদের গুদাম ঘর থেকে হরিণের চামড়ার উপরে অঙ্কিতো একটা ম্যাপ উদ্ধার করা হয় । ম্যাপটির অর্ধেকের বেশির ই ছিড়ে গিয়েছে । তবে যেই অংশ টুকু রয়েছে তাতে বিস্ময়ের শেষ ছিল না । পরীক্ষা করে দেখা যায় ম্যাপটি একেছেন অটোমান এডমিরাল পিরি রেইস, হিজরি সন ৯১৯, (১৫১৩/১৪ খ্রিস্টাব্দে)। ম্যাপ পরীক্ষা করে বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে যে সময়ে ম্যাপটা আঁকা হয়েছিল এবং ম্যাপের ভেতরে যতটা নিখুঁত ভাবে কিছু পৃথিবীর কিছু অংশ অঙ্কিত হয়েছে, তারও অনেক বছর পরে মানুষ সেই জাগয়া গুলো আবিস্কার করেছে ।

Piri Reis Map Source: www.ancient-origins.net

পিরি রেইসের মানচিত্রের সব টুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি । অর্ধেকের বেশি অংশ হারিয়ে গিয়েছে । বাকি যে অংশ টুকু পাওয়া গিয়েছে তাতে আফ্রিকা মহাদেশ, উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশ এবং ইউরোপের কিছু অংশ পাওয়া গিয়েছে । কিন্তু সব থেকে বিস্ময়কর হচ্ছে মানচিত্রে এন্টার্কটিকা মহাদেশের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া গেছে । এখানে বলে রাখা ভাল যে এন্টার্কটিকা মহাদেশটি ১৮২০ সালে আবিস্কৃত হয় । এই সময়ের আগের আঁকা কোন মানচিত্রে এন্টার্কটিকার কথা খুজে পাওয়া যায় না । তাহলে ১৫১৩ সালে অঙ্কিত একটা মানচিত্রে কিভাবে এন্টার্কটিকার অস্তিত্ব পাওয়া গেল ! আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে এন্টার্কটিকা মহাদেশের যে আকৃতি পিরি তার মানচিত্রে একেছেন সেই এন্টার্কটিকা মহাদেশটি বরফে ঢাকা ছিল না । একেবারে নিখুঁত ভাবে কেবল ল্যান্ড এরিয়া টুকু পিরি একেছিলেন ! এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে । এই সঠিক অবস্থান সম্পর্কে লেখক গ্রাহাম হ্যানকক বলেন “এন্টার্কটিকার অবস্থান সঠিক ভাবে দেখানোর চেয়েও বড় ধাঁধা হল বরফের আস্তরণ ছাড়া মহাদেশটির উত্তর প্রান্তের উপকূল সঠিক ভাবে দেখানো। মনে রাখতে হবে গত ছয় হাজার বছরে ধরে এন্টার্কটিকার উত্তর ভাগের তটরেখাকে কখনই বরফহীন দেখা যায় নি।”

এবার একটু চিন্তা করে দেখুন সেই সময়ে একজন অটোমান এডমিরাল কিভাবে এন্টার্কটিকা মহাদেশের খোজ পেলেন এবং বরফ ছাড়া এলাকাকে সুক্ষ ভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেন? এটার ব্যাখ্যার ব্যাপারে এরিক ফন দানিকেন তাই বইতে একটা হাইপিথেসিস দিয়েছেন । সেটার ব্যাপারে পরে আসছি । আগে ম্যাপ সম্পর্কে আরও কিছু বলা যাক । এই ম্যাপের গায়েই পিরি নানান রকম তথ্য উল্লেখ করেছেন । কোন স্থানে কী আছে, কোন ধরনের প্রাণী পাওয়া যায়, আবহাওয়া কেমন ইত্যাদি । এছাড়া তিনি এও লিখেছেন যে এই ম্যাপটা তৈরিতে তিনি মোটামুটি ২০টি মানচিত্র ও নোটপত্রের সাহায্য নিয়েছেন । এর ভেতরে পর্তুগিজদের তৈরি ভারত-চীনের চারটি মানচিত্র ছিল। আরবদের তৈরি ভারতবর্ষের একটা মানচিত্র ছিল, কলাম্বাসের তৈরি একটি মানচিত্র । এখানে আরও একটা কথা বলে রাখা ভাল যে কলাম্বাস মাত্র বিশ বছর আগে ইউরোপ থেকে ভুলক্রমে আমেরিকা আবিস্কার করেন এবং তার তৈরি কোন ম্যাপই উদ্ধার করা যায় নি আর । কালের বিবর্তনে সব হারিয়ে গেছে । তবে পিরির নোট থেকে এটা জানা যায় যে কলাম্বাসের একটি মানচিত্র তার কাছে ছিল । তার ম্যাপ লিস্টে আলেকজান্ডারের সময় কালে তৈরিকৃত ম্যাপের কথাও উল্লেখ রয়েছে । ধারণা করা হয় যে যেহেতু পিরি অটোমান এডমিরাল ছিলেন তাই তার কাছে রাজ্যের দুর্লভ পান্ডুলিপি থাকা মোটেই অসম্ভব কিছু ছিল না । আমরা সবাই জানি যে এক সময় বর্তমান তুরস্ক ইস্তানবুল জ্ঞানবিজ্ঞানের গুরুত্বপুর্ণ স্থান ছিল ।

এই মানচিত্রে দেখানো পাহাড় পর্বত গিরিখাতের উচু নিচু অংশ গুলো সুক্ষ এবং প্রায় নির্ভুল ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা ঐ সময়ে সমসাময়িক অন্য কোন মাত্রচিত্র শিল্পীর দ্বারা সম্ভব হয় নি । পিরি নিজেই মানচিত্রের একপাশে লিখেছেন এই মানচিত্রের মত আর কোন মানচিত্র অন্য কারো কাছে নেই । এছাড়া মানচিত্রে প্রতিটি মহাদেশের পাশে সংক্ষিপ্ত ভাবে সেই মহাদেশ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে । আরবি হরফে তুর্কি ভাষাতে এই সমস্ত বর্ণনা সেই মহাদেশ সম্পর্কে পিরি নিজের মত করে সেই এলাকা সম্পর্কে লিখেছেন । আফ্রিকা এবং আমেরিকা মহাদেশের চিত্র আঁকা হয়েছে প্রায় নির্ভুল ভাবে।

মানচিত্রে গ্রীনল্যান্ডে আকৃতিটাকে গবেষকরা ভুল উপস্থাপন ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে পিরি অঙ্কিত রেখা বরাবরই গ্রীনল্যান্ডের আসল ভুখন্ড । প্রশ্ন হচ্ছে বরফের নিচে শুয়ে থাকা আসল ভূখন্ডের ম্যাপ পিরি কিভাবে আঁকলো ? একই প্রশ্ন জাগে এন্টার্কটিকার বেলাতেও । কিভাবে এতো কোটি কোট টন বরফের নিচে চাপা থাকা ভুখন্ডের সঠিক চিত্র পিরি আঁকতে সক্ষম হল ? এমন কি পিরির ম্যাপে দক্ষিন মেরুর যে পর্বত মালা অঙ্কিত হয়েছে তা ১৯৫২ সালের আগে আবিস্কৃত হয় নি । এই পর্বত মালা শতশত বছর ধরেই বরফের নিচে চাপা পড়ে ছিল । বর্তমানে প্রতিধ্বনির সাহায্যে তার চিত্র আকা হয়েছে । এখন প্রশ্ন হচ্ছে পিরি কিভাবে এই পর্বত আঁকতে সক্ষম হল?

ওয়েল, এখানেই আমাদের এরিক দানিকেনের থিউরি চলে আসে ! এতো সময় পর্যন্ত আপনারা যারা পড়েছেন, কনস্পেরেসি ভাবনা যারা ভাবতে চান না, আর না পড়লেও চলবে। তারা এটা কেবল ভেবে নিতে পারেন যে প্রাচীন কালের মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে ছিলেন অনেক বেশি । এই রকম আরও অনেক অনেক উদাহরন আমরা দেখতে পারি যাতে দেখা যায় কোন উন্নত সভ্যাতা তখন ছিল ।

এবার আসি আমাদের এরিক সাহেবের কথায় । তিনি একটা ব্যাপার তাই বইতে লিখেছেন যা সত্যিই মনে প্রশ্ন জাগে । আমাদের হাতে এখন স্যাটেলাইটের মত প্রযুক্ত রয়েছে । এখন এই স্যাটেলাইট থেকেই ছবি তোলা যায় । এরিক লিখেছে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি আর পিরি রেইসের আকা ম্যাপ যদি আমরা পাশা পাশি রাখি তাহলে দেখা যাবে যে দুটো ছবির ভেতরে একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে । যেন মনে হবে পিরির মানচিত্রটি এই কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা অথবা এমন কোন ছবি দেখে আঁকা যা উপর থেকে তোলা হয়েছিল । তিনি ধারণা করেন যে পিরির হাতে এমনই কিছু ছবি এসেছিলো যা দেখে তিনি এই মানচিত্র এতো সুক্ষভাবে আঁকতে পেরেছিলেন । এবং সেই ছবি গুলো আকাশ থেকে তোলা হয়েছিলো অনেক অনেক বছর আগে যখন এন্টার্কটিকা বরফ নয়, বরং ভুখন্ড ছিল । সেই সময়ের কোন ছবি কি পিরির হাতে এসেছিলো? নয়তো সে কিাভবে এতো সুক্ষ ভাবে এইমানচিত্র আকতে পারলো ?

আমি আসলে কিছুই বলছি না । কিছু বিশ্বাসও করছি না । হয়তো এমন হতে পারে পিরি রেইস কেবল প্রাচীন নথি পত্র ম্যাপ থেকেই এই মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছিলেন এতো নির্ভুল ভাবে। অথবা সত্যিই তার কাছে এমন কিছু ছবি এসেছিলো?

পিরি রেইসের ম্যাপ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না । বইটা পড়তে গিয়ে এই পিরি সম্পর্কে জানতে পারি এবং ইন্টারেনেট থেকে আরও কিছু পড়া শুনা করে বাকি তথ্য সংগ্রহ করে পোস্টটা লেখা । এছাড়া পিরি রেইস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নিচে দেওয়া তথ্য সুত্র গুলো পড়তে পারেন । ইউটিউব ভিডিওটা দেখতে পারেন । ওটা বেশ চমৎকার ভাবে বানানো হয়েছে । সামনে আরও কয়েকটি রহস্যের কথা বলা আছে বইতে । সেগুলো পড়ে যদি মনে হয় লেখার মত সেটা নিয়েও আরও কয়েকটা পোস্ট লেখা যাবে !

আজকে এই পর্যন্তই

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4 / 5. Vote count: 5

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “পিরি রেইসের ম্যাপ কি এলিয়েন বা প্রাচীন কোন উন্নত সভ্যতার ইঙ্গিত দেয়?”

Comments are closed.