দ্যা ম্যাও প্রিন্সেস

4.8
(50)

সকাল বেলা রাফিক ভাইয়ের ফোনে ঘুম ভাঙ্গলো । অফিসের কাছেই আমি বাসা নিয়েছি তাই একটু বেলা করে আমি ঘুমাতে পারি । অফিসে ঢুকতে হয় সকাল দশটার আগে । আমি সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ঘুমাই শান্তিমত । রফিক ভাইয়ে ফোন পেয়ে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তাকিয়ে দেখি নয়টা তখনও বাজে নি । একটু বিরক্ত হলেও কিছু বললাম না । হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে রফিক ভাইয়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম !
-ফয়সাল কোথায় তুমি ?
ইচ্ছে হল বলি যে তাজিংডংয়ের উপরে আছি । মেঘ দেখতে আসছি । এই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার মানে কী আমি আজও ঠিক বুঝতে পারি না । মানুষ যে প্রশ্নের উত্তর আগে থেকে জানে সেই প্রশ্ন কেন করে ? রফিক ভাই খুব ভাল করেই জানে যে জীবন মরন সমস্যা না হলে এই সময়টা আমি সব সময় বিছানাতে থাকি ।
আমি বিরক্ত চেপে বললাম, যেখানে থাকি !
-আরে মিয়া উঠো জলদি ! খবর শুনছো নাকি?
-কিসের খবর?
-আরে মিয়া এমডি বদলাইয়া গেছে !

বলেই রফিক হেহ হে করে উঠলো । আমার ঘুম চলে গেল সাথে সাথেই । আমার কান সোজা করে বললাম, কে হয়েছে নতুন এমডি?
-গেস কর?
-কে?
রফিক ভাই বলল, টিভি চালু কর। তাহলেই বুঝতে পারবে নতুন এমডি কে হইছে !

আমি দেরি না করে টিভি চালু করলাম ! সাথে সাথেই চমকে গেলাম ।

যে কয়টা বাংলা চ্যানেল ঘুরলাম প্রতিটার সংবাদই একই খবর দেখাচ্ছে ! কয়েক মিনিট খবরের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে ।

দেশের বিখ্যাত শিল্পপতি রশিদ আরমানের বড় ছেলে রিগু আরমানের বিভৎস মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে বুড়িগন্ধা থেকে । রিভু আরমান মানে তার মেঝ সন্তান পলাতক । তাকে আজ সকালের ফ্লাইটে জার্মানি চলে যেতে দেখা গেছে । দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে কারো কষ্ট হয় নি । সম্ভবত বড় ভাইকে খুন করে সে বিদেশ পালিয়ে গেছে । এখন থাকে এক মাত্র ছোট মেয়ে রিয়ানা আরমান । খুব পরিস্কার ভাবেই রিয়ানা আমাদের কোম্পনীর নতুন এমডি হতে চলেছে !

আসলে বেশ কয়েকদিন ধরেই তিন ভাই বোনের ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব চলে আসছিলো যে কে বসবে কোম্পানীর এমডির পদে । তাদের বাবা অর্থ্যাৎ আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবও কোন সিদ্ধান্ত জানাচ্ছিলেন না । কেমন একটা লুকোচুরি খেলছিলেন । আমার কাছে মনে হচ্ছিলো যে তিনি নিজেও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না । বিশেষ করে তিনজনই যখন সমান দাবিদার ।
ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন বড় ছেলেকে । তবে সে বলেছিলেন যে খুব জলদিই জানাবেন যে স্থায়ী ভাবে কে এমডি পদে বসবেন !

কিন্তু রিগু আরমান যে খুন হয়ে যাবে সেটা আমরা কেউ ভাবতেও পারি নি । আর যেহেতু রিভু মিয়া পালিয়েছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় সে সেই অকাজটা করেছে । ফাঁক তালে রিয়ানা ম্যাডামের লাভ হয়ে গেল । তবে কেন জানি ব্যাপারটা আমার কাছে ঠিক হজম হল না ।

আমাদের চেয়ারম্যানের দুইটা বিয়ে । প্রথম পক্ষের সন্তান হল দুই ভাই । আর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান হচ্ছে রিয়ানা । খুব স্বাভাবিক ভাবেই দুই ভাইয়ের ভেতরে মিলটা বেশি ছিল । দ্বন্দ্ব যখন শুরু হয় তখন স্পষ্টই দুই ভাই মিলে রিয়ানাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো কোম্পানী থেকে । কিন্তু এখন দেখছি দুই ভাইয়ের লড়ায়ে লাভ হল রিয়ানার !

আমি হাত বাড়িয়ে মিউকে খুজতে শুরু করলাম । রাতে সে আমার সাথেই ঘুমিয়েছিলো । পুরো রুমের ভেতরে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সে নেই । নিশ্চিত ভাবেই গায়েব হয়ে গেছে । প্রতিদিনের মত আজও সে একই কাজ করেছে । রাতে আসে যখন আমি অফিস থেকে বাসায় আসি । সারারাত আমার গা ঘেষে ঘুমিয়ে থাকে । তারপর সকাল হলে আবার চলে যায় !

আমি জলদি জলদি উঠে পড়লাম । আজকে আজকে একটু আগে আগে অফিস যেতে হবে । এমডি বদলেছে সুতরাং অনেক কিছু বদলে যাবে ! আমাকে আগে আগে যেতে হবে ।

রশিদ আরমানের ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই একটু যেন কেমন মনে হয়েছে । লোকটার ভেতরে রুক্ষতার পরিমানটা অনেক বেশি । মায়াদয়া কম । তার বড় ছেলে মারা গেছেন সেটা সেটা তার মুখের ভাব কিংবা কথায় বিন্দু মাত্র প্রকাশ পেল না । বরং দুপুর একটার সময়ে সে কোম্পানীর নতুন এমডি ঘোষণা দিলেন ।
রিয়ানা আরমান ।

তিনটার ভেতরে কোম্পানীর ওয়েব সাইটে সকল মেম্বারদের নামের তালিকা প্রকাশ পেল । আমরা এটা আগে থেকেই জানতাম যে রিয়ানা যখন নতুন এমডি হবে তখন বেশ কিছু রদ বদল হবে । কয়েকজন চাকরিও হারাবে । রিগু আরমান যখন কোম্পানী চালাচ্ছিলো তখন তার কিছু পছন্দের এপ্লোয়ী ছিল । তাদের সবাইকে ছাটাই করা হল । কয়েকজনকে পদন্নোতি দেওয়া হল । সেই সাথে কয়েকজনকে নামিয়ে দেওয়া নিচের পোস্ট ।

কিন্তু সব থেকে অবাক করা ব্যাাপর হচ্ছে আমার নাম কোথাও নেই । এটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমাদের কোম্পানির ওয়েব সাইটেই প্রতিটি এম্প্লোয়ীর নাম সেই সাথে কার কি দায়িত্ব সব কিছু প্রকাশ করা থাকে । নতুন ভাবে প্রকাশিত দায়িত্ব সবার নতুন দায়িত্ব পেয়েছে । যারা যারা চাকরি হারিয়েছে তাদেরকে নামের নিচে এক্সপেল লেখা । কিন্তু এই সবের মাঝে আমার নাম একদম নেই । না আমার পদউন্নতি হয়েছে, না আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে । তবে আমার আগের যে পোস্ট টা ছিল সেখানে ঠিকই একজন নিয়ম দেওয়া হয়েছে ।

আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । রফিক ভাই আমাকে সান্তনা দিয়ে বললেন যে কোন চিন্তা যেন আমি না করি । সে আমার ব্যাপারটা নিয়ে রিয়ানা ম্যাডামের সাথে কথা বলবে । রিয়ানা ম্যাডাম অফিসে নেই আপাতত । কাল আসলেই এই ব্যাপারে কথা বলবেন। তার কথায় এখন বেশ মূল্য । রফিক ভাইকে এজিএম করা হয়েছে । আমি মন খারাপ নিয়ে বেশ কিছু সময় বসে রইলাম । তারপর টেবিল পরিস্কার করে বাসায় চল এলাম । আমার কি কাজ ওখানে । সম্ভবত চাকরি চলেই গেছে আমার ।

ঘরে ঢুকতেই দেখি সোফার উপরে মিউ বসে রয়েছে চুপচাপ । টিভি চলছে । আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম যে যাওয়ার সময় কি আমি টিভি চালু করে গিয়েছিলাম ! মনে করতে পারলাম না । অবশ্য সেটা নিয়ে আর খুব একটা ভাবলামও না । এগিয়ে এসে মিউকে কোলে তুলে নিলাম । ওর নরম তুলতুলে শরীরে হাত দিতেই আমার মনটা ভাল হয়ে গেল অনেকটাই । আমার আদর পেয়ে মিউ যেন আরাম পেল । মিউ মিউ করে ডেকে উঠলো ।
আরও আদর পেতে চাইছে । আমি মুখের কাছে নিয়ে ওর কপালে একটু চুমু খেলাম । একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে । এই সেন্ট টা ওর শরীরে সম্ভবত ন্যাচারালি তৈরি হয় । আমি ওকে গোসল করাই ঠিকই তবে কোন আলাদা সুগন্ধী মাখিয়ে দেই না । আলাদা ভাবে এটা কোথা থেকে আসে কে জানে । আমি ওকে আরও একটু আদর করলাম । তারপর বলল, জানিস মিউ আজকে আমার চাকরি চলে গেছে !
সে বলল, মিউ !
-সত্যি । আমি বুঝতেই পারলাম না আমি কী করলাম । আমাকে তো রিয়ানা ম্যাডামের চেনার কথা না । এমন কি আমি কোন তার ভাইদের দিকের লোকও না । আমার কি মনে হয় জানিস, কেউ আমার নামে তার কানে কিছু বলেছে ।
-মিউ ।
-নাহ ! আমি আর যাবো না । চাকরির জন্য মোটেও তেল দিবো না । নতুন চাকরি পেয়ে যাবো । আর হাতে হাতে বেশ কিছু টাকা জমানো আছে । ৪/৫ মাস এমনিতেই চলে যাবে । –
-মিউ ।
আমি বললাম, দাড়া আমি গোসল করে আসি । তারপর আজকে তোর সাথে সেই গল্প করবো ।

আমি বাসায় একাই থাকি । কাজের একটা লোজ আছে রান্না করার জন্য । আমি যখন অফিসে থাকি সে এসে রান্না করে দিয়ে যায় । তার কাছে চাবি রাখা আছে । তাই কাপর চোপড় বদলানো, ওয়াশরুমে যাওয়া এগুলোর সময় আমি খুব একটা দরজা আটকাই না । আজও আটকাই নি ।

সম্পূর্ন কাপড় ছেড়ে গোসল পরার সময় খেয়াল হল মিউ এসে দাড়িয়েছে দরজার কাছে । একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এই ব্যাপারটা এই বেড়ালের ভেতরে খুব আছে । আমার সাথেই সে প্রতিবার গোসল করে । আমি হাত বাড়িয়ে ডাক দিতেই সে দৌড়ে চলে এল ঝর্ণার নিচে । দুজন মিলে বেশ লম্বা সময় ধরে গোসল করে বের হলাম।

পরের দিন আমার অফিস যাওয়ার কোন তাড়া ছিল না । তাই মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করে ঘুমালাম । রাতে একটু দেরি করেই ঘুমিয়েছিলাম । যেহেতু সকালে কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই । ঠিক করেছিলাম যে সকালের আর দুপুরের খাবার এক সাথে খাবো কিন্তু আমাকে জেগে উঠতে হল ।
আমার ঘুম খুব বেশি গাঢ় না । একটু শব্দ হলেই আমি জেগে উঠি । আজকে জেগে উঠলাম ফোনের শব্দে । কোন মতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে কোন নাম্বার নেই । লেখা প্রাইভেট নম্বর ।
ঘুম চোখে একটু অবাক হতে হল । পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে এই ভিআইপি নম্বরের প্রচলন আছে ! আমাদের দেশেও আছে, সেটা তো জানা ছিল না । আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম ! কোন প্রকার সম্মোধব ছাড়াই সে বলল, আপনার অফিসে আসার কথা দশটার আগে ! ইতিমধ্যে এগারো মিনিট লেট আপনি !

আমার ঘুম ছুটে গেল সাথে সাথেই । আমি কোন দিন রিয়ানা ম্যাডামের সাথে সরাসরি কথা বলি নি । কিন্তু আমি তার কন্ঠে চিনে ফেললাম সাথে সাথেই । এই মেয়ে আমাকে কেন ফোন দিয়েছে !
নিজে ফোন দিয়েছে !
খাইছে আমারে !
আমি কোন মতে বললাম, আসলে ম্যাম আমার তো চাকরিই নেই !
-কে বলেছে যে নেই?
-আসলে বোর্ডে আমার নাম নেই তো !
-আর ইউ সিওর ?

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম । কালকে অফিস থেকে আসার পরে আমি আর বোর্ড চেক করি নি । হয়তো বিকেল কিংবা রাতের বেলা আমার নাম এন্ট্রি করা হয়েছে । আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । ওপাশ থেকে আবারও তার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম ।
-আপনাকে আধা ঘন্টা সময় দিলাম । এর ভেতরে আমার কেবিনে হাজির হবেন ।

লাইণ কেটে গেল !

ফোন কাটার পরেও আমি কিছুটা সময় চুপ করে বিছানাতেই পড়ে রইলাম । আমার ঠিক বিশ্বাস হল না যে রিয়ানা ম্যাডাম আসলেই আমাকে ফোন দিয়েছে । নিজে ফোন দিয়েছে ! নাকি আমি ঘুমের ভেতরেই স্বপ্ন দেখলাম এতো সময়ে ।
কিন্তু দুই মিনিট পরে বুঝতে পারলাম যে আমি আসলেই স্বপ্ন দেখছিলাম না । রিয়ানা আরমান সত্যিই সত্যিই আমাকে ফোন দিয়েছিলো । আমি আর দেরি করলাম না । অফিস আমার বাসার কাছেই । তাই তৈরি হয়ে সেখানে পৌছাতে আমার খুব একটা বেশি সময় লাগলো না ।

রিয়ানা আরমানের কেবিনের সামনে এসে কিছু সময় চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । অনুভব করতে পারছিলাম যে বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছে । খানিকটা ভয়ভয়ও করছে । এই কেবিনের ভেতরে আমি কোন দিন ঢুকি নি । কোন দিন ঢোকার সুযোগ আসবে সেটাও কোন দিন ভাবি নি । যদিও আমি এখনও ঠিক জানি না যে আমি এর ভেতরে ঢুকে কী করবো আর আমাকে এখানে কেনই বা ডাকা হয়েছে !

আমি বড় একটা দম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । ঢুকতেই দেখি রিয়ানা আরমান একেবারে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । যেন তিনি জানতেনই আমি ঠিক এই সময়েই ঘরে ঢুকবো । আমার অবশ্য কেবিনে ঢোকার আগে একবার নক করা দরজার ছিল ।
রিায়ানের চোখে সানগ্লাস নেই । আর আগে আমি তাকে যতবার দেখেছি ততবার তার চোখে কালো সানগ্লাস দেওয়া ছিল । আজকে তার চোখ আমি সরাসরি দেখতে পাচ্ছি ।

আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে । আমি কিছুতেই সেই অদ্ভুত সুন্দর চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিতে পারলাম না । একভাবে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে । হাকলা নীল চোখ !

আমাদের দেশের মেয়েদের চোখের রঙ সাধারনত কালো কিংবা হালকা খয়েরী হয় । নীল চোখ আগে দেখেছি বলে মনে পড়লো না । অথবা এমন হতে পারে রিয়ানা আরমান চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেছে । ইদানীং অনেকেই এমনটা পড়ে । আমার মনের কথা রিয়ানা কিভাবে বুঝে গেল আমি জানি না । সে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বলল, আমি কন্ট্যাক্ট লেন্স পরি না !

আমি কথাটা শোনার সাথে সাথ চমকে গেলাম । এই মেয়ে কিভাবে জানলো যে আমি তার নীল চোখের কথাই ভাবছি ! আবারও আমার মনের কথা যেন সে বুঝতে পারলো । বলল, কীভাবে বুঝলাম এই ভাবছেন তো ! এটাই স্বাভাবিক না ? যেই আমার চোখ সরাসরি দেখে সবার আগে ভাবে যে আমি হয়তো কন্ট্যাক্ট লেন্স পরেছি । কারণ এই দেশের মেয়েদের চোখের রং নীল হয় না । তাদের অবাক হওয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি । যাই হোক আসুন ! বসুন আমার সামনে !

আমি ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম । মনের ভেতরে তখনও কেমন যেন মনে হচ্ছে । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই । আমার কেবল মনে হচ্ছে যে সামনে বসা এই মেয়েটির ভেতরে কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে । কিন্তু কী সেই অস্বাভাবিকত্ব সেটা আমি ধরটে পাচ্ছি না । আমি রিয়ানা আরমানের দিকে তাকিয়ে রইলাম আরও কিছু সময় । অথবা বললে ভাল হয় যে আমি বাধ্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । কিছুতেই আমি আমার চোখ সরিয়ে নিতে পারি নি ।

রিয়ানা বলল, আপনার নতুন পোস্ট সম্পর্কে কোন কিছু বলার আছে কি?
আমি বললাম, আসলে আমি জানিই না যে আমার পোস্ট টা কি?
রিয়ানা হাসলো । তারপর একটা খাম আমার দিকে এগিয়ে দিল । খামটা খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠলো । আমাকে এমডির পিএস বানানো হয়েছে । আমার অবাক হওয়ার ব্যাপারটা যেন রিয়ানা খুব উপভোগ করছে । তার মুখের হাসির দিকে তাকিয়েই আমি সেটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম । আমার মাথায় ঠিক এমন কিছু আসছিল না যে আমি এমন কী করলাম যে আমাকে হঠাৎ করেই রিয়ানা তার পিএস বানিয়ে দিল !
কিছু একটা কারণ তো আছেই । আমাকে সেই কারণটা খুজে বের করতে হবে !

আমার আগের সেই সুখের দিন আর রইলো না । আমি যেমন আগে অফিস শুরু হওয়ার ঠিক আধা ঘন্টা আগে উঠতাম, অফিসে আসতাম এখন আর সেটা হচ্ছে না । আমাকে উঠতে হয় বেশ আগেই । আমার বাড়ির কাছে গাড়ি এসে উপস্থিত হয় । সই গাড়িতে চড়ে আমাকে গিয়ে হাজির হতে হয় রিয়ানা ম্যাডামের বাসায় । সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসতে হয় অফিসে । তারপর সারাদিন তার সাথেই ঘোরাঘুরি । রাতে একেবারে তাকে বাসায় দিয়ে এসে আমাকে বাসায় আসতে হয় । অবশ্য গাড়ি আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌছে দেয় ! বাসায় এসে আমার ক্লান্তিতে শরীর ভরে ওঠে । অবশ্য বাসায় আসার আগেই দেখি মিউ সোফার উপরে বসে রয়েছে । আমি ঘরে ঢুকতেই সে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে । আমার কাছ থেকে কিছু সময় আদর নেয় । তারপর শোবার ঘরের দিকে চলে যায় । এটা হচ্ছে তার সাথে এখন ঘুমাতে হবে সেই ইঙ্গিত ! আমিও, ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়তাম । এভাবে কিভাবে মাস খানেক পার হয়ে গেল সেটা টেরই পাই নি ।

তারপরই একদিন নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো । সেদিন রিয়ানা ম্যাডামকে বাসায় রেখে আমিও বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । মাঝ পথেই গাড়িটা কেমন যেন করে উঠলো । কিছুদুর গিয়েই গাড়িটা থেমে গেল । আমার বাসা থেকে তখনও গাড়িটা একটু দুরে । গাড়ি ঠিক হতে কত সময় লাগবে কে জানে, আমি এই ভেবেই গাড়ি থেকে নেম পড়লাম । এখান থেকে বাসায় হেটে যেতে খুব বেশি হলে মিনিট বিশেষ লাগবে । আর পথে যদি রিক্সা পেয়ে যাই তাহলে তো আরও কম সময় লাগবে ।

গাড়ি থেকে নেমে হাটা দিবো তখনই ড্রাইভার বলল, স্যার গাড়ি থেকে নাইমেন না । ঠিক হয়ে যাইবে এখনই !
-আরে সমস্যা নেই । এখান থেকে হেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না !
-ম্যাডাম আমারে কইছে আপনেরে বাসার সামনেই নামায়ে দিতে । আগে যেন না নামিয়ে দেই !
-তোমার ম্যাডামকে বলার দরকার নেই । তাহলেই তো হল ! কোন চিন্তা কর না । তুমি গাড়ি ঠিক করে চলে যাও । ম্যাডাম কিছু জানতে চাইলে বলবে যে আমাকে নামিয়ে দিয়েই গেছো । আমিও তাই বলবো । ব্যাস !

আমি আর দাড়ালাম না । গাড়ি থেকে নেমে হাটা দিলাম । আমার কাজটা যেন ড্রাইভার মজিদের মোটেও পছন্দ হল না । তবে সে আমাকে বাঁধাও দিতে পারলো না । আমি আপন মনে হাটতে শুরু করলাম । যদি কোন রিক্সা নাও পাই তবুও খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না !

আমার বাসা যখন আর মিনিট দশেক দুরে রয়েছি তখনই অনুভব করলাম যে জায়গাটা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে । এমন কি রাস্তায় কোন আলোও জ্বলছে না । আমি আগেই বলেছি আমি থাকি অফিসের কাছাকাছি । পিক আওয়ারে এই এলাকাটা বেশ জমজমাট থাকে কিন্তু ছুটির দিন গুলোতে কেমন যেন নিশ্চুপ আর নির্জন মনে হয় । এই যে অফিস ছুটির পরে এই স্থানটা যেন মৃত্যুপুরি হয়ে গেছে । কিন্তু আজকে যেন আরও বেশি নির্জন মনে হচ্ছে । এতো নিশ্চুপ হওয়ার কারণ কী?

আমি দ্রুত হাটতে শুরু করলাম । তখনই আমার মনে হল কেউ যেন আমার পেছন পেছন হাটছে ।
যতদুরে চোখ যায় আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । রাস্তার পাশে অন্য দিন হকারের দোকান বসে, রিক্সাওয়ালা থাকে আজকে কেউ নেই কিছু নেই ! ঢাকা শহর এতো নির্জন হয় নাকি?
এই ব্যাপারটা আমার কাছে সত্যিই বেশ অস্বাভাবিক মনে হল । আমি দ্রুত পা চালালাম । সেই সাথে এবার সত্যিই অনুভব করলাম খুব আস্তে সমর্পনে কেউ যেন আমার পিছু নিয়েছে । সে রাস্তায় এমন ভাবে পা ফেলছে যে আওয়াজ হচ্ছেই না একদম । তারপরেও আমি তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি । আমি এবার হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম । অনুভব করলাম পেছন থেকেও হাটার গতি বেড়ে গেছে ।

নিজেকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম যে কোন ভাবেই পেছনে তাকানো যাবে না, সামনে এগিয়ে যেতে হবে । তবে সেটা আর হল না । আমি পেছনে তাকিয়ে ফেললাম । আর তাতেই মনে হল যে তাকানোটা মোটেই ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না । আমার থেকে হাত বিশেষ দাড়িয়ে রয়েছে । মিশমিশে কালো দেহ । দেহে কোন পোশাক নেই তার । সব কিছু অন্ধকার কেবল তার চোখ ছাড়া । কোন মানুষের চোখ এমন লাল হতে পারে আমার সেটা ধারণা ছিল না । সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার মনে হল এখান থেকে আমার এখনই পালাতে হবে । যে কোন ভাবেই আমাকে পালাতেই হবে । কিন্তু তখনই অনুভব করলাম যে আমি একদমই নড়তে পারছি না । আমার পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে । ঐ চোখের দিক থেকে আমি নিজের নজর সরাতে পারছি না একদমই । আমাকে যেন সম্মোধন করে ফেলেছে সে । সে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে । আমি অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলাম কেবল । আমার যেন কিচুই করার নেই । যতই সে এগিয়ে আসতে লাগলো ততই আমি তার অয়বয়টা ভাল করে ধরা পড়তে লাগলো আমার চোখ । হ্যা সে দেখতে মানুষের মতই । তারপরেও আমার মনে হল যে সে মানুষ না ।

সে আরও এগিয়ে এল আমার দিকে । যখন আমার থেকে আর মাত্র কয়েক হাত দুরে তখনই একটা অবাক করা ব্যাপার ঘটলো । আমি দেখতে পেলাম কোথা থেকে যেন মিউ লাফিয়ে এসে পড়লো আমাদের দুইজনের মাঝে । তারপর সামনের ঐ প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে প্রবল কন্ঠে ডেকে উঠলো । সাথে সাথেই আরও অবাক করা ঘটনা ঘটলো । কোথা থেকে যেন আরও সাত আটটা বেড়াল আমাকে ঘিরে ধরলো । এমন ঐটার দিকে আক্রমনত্মক ভঙ্গি করে হিশহিস করতে লাগলো । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । কী হচ্ছে, আর কেন কীভাবে হচ্ছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকলো না আমার । তবে দেখলাম সেই লাল চোখের মানুষটা পিছাতে শুরু করলো । আস্তে আস্তে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
তখনই আমি নিজেকে ভার মুক্ত অনুভব করলাম । আমার সামনেই মিউ দাড়িয়ে ছিল । আমি দ্রুত মিউকে কোলে তুলে নিলাম । তারপর আমার বাসার দিকে হাটা দিলাম । আমি আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম । আমাদের আশে পাসে ঐ অন্য বেড়াল গুলও আসতে লাগলো। আমার কাছে মনে হল ওরা যেন আমাকে গার্ড দিয়ে নিয়ে আসছে বাসায় । বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল । মিউকে নিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছি এমন সময় সে আমার কোল থেকে ঝাপিয়ে পড়লো । তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
ঐদিন রাতে মিউ আর বাসায় এলো না । আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা অস্বাভবিক মনে হল । তবে এটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই । আমি খুজেও পেলাম না ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 50

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

5 Comments on “দ্যা ম্যাও প্রিন্সেস”

  1. দ্বিতীয় পার্ট তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য অনুরোধ রইল।

  2. ২য় পার্ট এখনো দেন নাই ভাইয়া, খুব দুঃখ পেলাম, একটু তারাতাড়ি দেন প্লিজ ভাইয়া

Comments are closed.