এক
বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে আমার কোনকালেই ভাল লাগতো না । আজ পর্যন্ত যত বিয়ের দাওয়াত এসেছে আমি সব কয়টা এড়িয়ে গেছি । এমনকি ঘনিষ্ঠ কারোর বিয়ে হলেও । মাঝে মাঝে মনে হত নিজের বিয়েতেও হয়তো আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না । মানুষজনের ভীড় আমার কেন জানি একদম ভাল লাগে না ।
কিন্তু নিজের আপন বড় ভাইয়ের বিয়েতে না যাওয়া কোনভাবেই ভাল কিছু দেখায় না । তার উপর বাবার চোখ রাঙ্গানি তো আছেই ।
একটু যেন তাড়াহুড়া করেই ভাইয়ার বিয়ে হচ্ছে । ভাইয়া সবেমাত্র চাকরী পেয়েছে । এখনও বছরও পার হয় নাই । এতো জলদি ভাইয়ার বিয়ে না দিলেও পারতো আব্বা । কিন্তু আব্বার কথার উপর কথা কে বলবে? তিনি যা একবার ভেবে বসবেন তাই হবে । আমরা খুব ভাল করে জানিও না ভাইয়ার বিয়ে কোথায় হচ্ছে । মেয়ে বাবার পছন্দের । বেশ ভাল ঘরের । প্রভাব প্রতিপত্তি আছে । তাড়াহুড়া করে আমাকে আর ভাইয়াকে ডেকে আনা হয়েছে ঢাকা থেকে । ভাইয়াকে নিয়েই মেয়ে দেখতে গিয়েছিল । সেদিনই বিয়ের তারিখ ঠিক করে এসেছে আব্বা ।
আমি অবশ্য আমার পরীক্ষা বলে কাটাতে চেয়েছিলাম, পরে মনে হল থাক কি আর হবে । কুরবানী তো ভাইয়া হচ্ছে, আমি না হয় দূর থেকেই দেখলাম ! তাছাড়া এত বড় দুঃসময়ে যদি আমি আমার ভাইয়ের পাশে না থাকি তাহলে আর কে থাকবে ।
ভাইয়ার বিয়ের জন্য আব্বা মোট ১১ টা মাইক্রো ভাড়া করেছে । আর একটা কার গাড়ি । কার গাড়িটা বরের জন্য, মানে বরের গাড়ি হিসাবে সাজানো হয়েছে ।
সবার আগে আমাদের কার গাড়িটা চলতে শুরু করলো । আর পরপর বাকীগুলো । একটু অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের গাড়িতে আমি আর ভাইয়া ছাড়া আর কেউ নেই । অন্য কেউ উঠতে চেয়েছিল কিন্তু ভাইয়া কেন জানি তাদেরকে উঠতে দেয় নি । এমনকি ভাইয়ার বন্ধুরা রয়েছে অন্য গাড়িতে । কেউ অবশ্য মানা করে নি । কেন দেয় নি আমার অবশ্য জানি না । আমাদের গাড়িটা বেশ দ্রুতই চলছে । ভাইয়া বিরস মুখে অনেকটা সময় ধরেই বসে রয়েছে আমার পাশে ! আমি ভাইয়াকে রিলাক্স করার জন্য বললাম,
-ভাইয়া মেয়ে কি সুন্দর না ? আমি তো ছবি দেখেছি ! বেশ ভাল ! চিল !
ভাইয়া আমার কথায় খুব একটা কান দিল না ! অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো ।
-আরে ভাইয়া । সবাই তো বিয়ে করে । করতে হয় । সমস্যা কি !
-তুই কর !
-আরে আমিও তো করবো ! তবে সময় আসুক ! আমি তো কেবল …..
-মনে হচ্ছে আমি খুব বড় হয়ে গেছি ? তুই জানিস আমি এখানে কবুল বলবো আর ঐ দিকে সুচি বলেছে ও ১০ তলা থেকে ঝাঁপ দিবে !
আমি বললাম,
-সুচিটা কে ?
-আমার কলিগ ! একসাথেই পড়তাম । এখন এক সাথে চাকরি করি ।
-আব্বা কে বলতা !
-আব্বা শুনতো বলে তোর মনে হয় ?
-তা অবশ্য ঠিক । কি আর করা । বেটার লাক নেক্সট টাইম !
-লাক মাই ফুট ! আমি এই বিয়ে করবো না !
আমার কেন জানি ভাইয়ার জন্য একটু মায়া হল । কিন্তু মায়া হলেও কিছু করার নেই ! এখানে আমার কিছুই করারও নেই । আব্বার উপরে কথা বলবো এতো বড় সাহস আমার বড় ভাইয়েরই হয় নাই, আমার কিভাবে হবে ? জানি কিছুই হবে না । ভাইয়া কিছুটা গাইগুই করবে, তারপর চুপ হয়ে যাবে । আসলে এইজন্যই মনে হয় গাড়িতে আর কাউকে উঠতে দেয় নাই । আমার সাথে যেন একটু সুখ দুঃখের কথা বলতে পারে ।
আমি একটু পরেই লক্ষ্য করলাম যে আমাদের গাড়ি বেশ আগে চলে এসেছে । বেশ দ্রুতই চলছে । পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের পেছনের কোন গাড়িই দেখা যাচ্ছে না । ভাইয়াও আমার দেখাদেখি পেছনে তাকালো । যখনই দেখলো পেছনে কেউ নেই তখনই ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে ।
আমি বললাম,
-থামানোর কি দরকার ? স্লো করুক !
-চুপ থাক ! বেশি বুঝবি না !
গাড়ি থামতে না থামতেই ভাইয়া বের হয়ে গেল । রাস্তা থেকে নেমে গেল নিচে ! ভাবলাম হয়তো ভাইয়ার হয়তো বাথরুম চেপেছে । কিন্তু পরক্ষণেই আমার ভুল ভেঙ্গে গেল । আসলে ভাইয়া রাস্তা থেকে নামছে বাথরুম করার জন্য না । পালানোর জন্য ।
পালিয়ে যাবে !!
এতোদিন জানতাম মেয়েরা বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায় এখন দেখছি ভাইয়া বিয়ের আসর থেকে ……
না ঠিক বিয়ের আসর না বিয়ের গাড়িবহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে । খাইছে আমারে ….।
-ভাইয়া ! শুনো ভাইয়া ……
কিন্তু কে শোনে কার কথা । আমার চোখের সমানেই ভাইয়া গাছপালার ভেতরে আড়াল হয়ে গেল । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ।
আমার তখনই মনে হল, খাইছে এখন কি হবে ? আমার আব্বাজান তো ভাইয়া একদম খুন করে ফেলবে ।
সাথে আমারও খবর আছে !
আমিও কি পালাবো ভাইয়ার পিছু পিছু ?
না থাক !
আমি বরং দাঁড়িয়ে থাকি ! আব্বার মাথা নিশ্চয় খারাপ হয়ে যাবে ! অবস্থা বেগতিক দেখলো তখন দৌড় মারা যাবে ।
৫ মিনিটের ভেতরেই গাড়িবহর দেখা গেল ! আমি দুরু দুরু মন দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ! অনেকদিন আব্বার রাগের সামনে পড়তে হয় নি । এখন হবে ।
নাহ ! পরীক্ষার অযুহাত দিয়ে না আসলেই ভাল হত । এই ঝামেলার ভেতরে পড়তে হত না ।
দুই
ভাইয়ার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে । তাকে যদি বাড়ির আশেপাশে দেখা যায় তাহলে যে-ই দেখবে, সে যেন নিজ দায়িত্বে তাকে প্যাদানি দেয়। সেই সাথে পরিবারের সকল সদস্যের সাথে ভাইয়ারর দেখা-সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বলার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে । সেই দুর্ঘটনার পরে আমি নিজেই এখনো নিজের কাছে সুস্থির হতে পারি নি, তার ভেতরে ভাইয়ার ফোন এসে হাজির ।
-অপু কোথায় রে তুই ? ঢাকায় এসেছিস ?
-হুম ।
-এক কাজ কর আজকে সন্ধ্যার দিকে আয়, দেখা করি !
একটু মেজাজ খারাপ হল । আমি আর ভাইয়া দুজনই ঢাকায় থাকি প্রায় তিন সাড়ে তিন বছর হল । কিন্তু আমরা একসাথে থাকি না । আমার কেন জানি তার সাথে থাকতে ভাল লাগে না । আমি একাই থাকতে ভালবাসি । ভাইয়াও সেকরম । খুব দরকার না পড়লে সে আমাকে ফোন করে না ! এমনি এমনি দেখা করার তো প্রশ্নই আসে না । আর আজকে বলতেছে ‘আয় দেখা করি’ ।
অবশ্য তার আকামের জন্য যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে সেইজন্য হয়তো সরি ফিল করছে । একবার ভাবলাম যে বলি আমার কাজ আছে । কিন্তু বললাম না ।
ভাইয়া বলল,
-সুচিও দেখা করতে চাইছে তোদের সাথে ।
-তোদের ? তোদের মানে ?
-আরে তুই আর তৃষার সাথে । মেয়েটার নাম তৃষা তো ?
মেয়েটার নাম আমি নিজেই ঠিকমত জানি না আর ভাইয়া দেখি ঠিক ঠিকই জানে । আর জানবে না-ই বা কেন ? ভাইয়ার সাথেই তো বিয়ে হতে যাচ্ছিলো । কিন্তু তাকে রেখে সে পালিয়ে গেছে । আমি কি বলবো খুঁজে পেলাম না ।
-তৃষা তো তোর ভার্সিটিতেই পড়ে । তাই না ?
-হুম !
-ওকে ফোন করে দে ।
আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিল । আমি তৃষাকে ফোন দিলাম না । কেবল একটা মেসেজ করে দিলাম । বাসা থেকে আসার পর তৃষার সাথে আমি একদিনও কথা বলি নি । বলতে পারি নি । ভাইয়ার জন্য যা হয়েছে সেইজন্য ও নিজে যেমন অস্বস্তিতে আছে, আমিও ঠিক তেমনই । কি কথা বলবো কিংবা কি কথা বলা উচিৎ এখনও বুঝতে পারছি না । আরও কটা দিন যাক তারপর বোঝা যাবে ।
সন্ধ্যার সময় ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির হলাম । গিয়ে দেখি ভাইয়া আর তার পাশে সেই সুচি আপু বসে আছে । একটা কথা বলতেই হবে যে দুজনকেই মানিয়েছে বেশ । আমাকে দেখে দুজন হাসলো ।
ভাইয়া বলল,
-তৃষা কই ?
-আসছে ।
-একসাথে আসবি না ?
-আরে আমরা কি একসাথে থাকি নাকি ? ও কখন আসবে আমি কিভাবে বলবো ? আসবে কি না তাও জানি না ।
-কথা হয় নি ।
-না !
ভাইয়া একটু রাগ করতে গেল কিন্তু সুচি আপুর জন্য কিছু বলল না । সম্ভবত তৃষা আসবে না । কেন আসবে? আসার কি কোন কারণ আছে ?
কিন্তু আমাকে খানিকটা ভুল প্রমানিত করে দিয়েই তৃষাকে আসতে দেখলাম । নীল রংয়ের একটা চুড়িদার পরে আসছে । রেস্টুরেন্টের উজ্জ্বল আলোতে ওকে যেন আরও বেশি সুন্দর লাগছে । মাথাটা একটু নিচ করে আস্তে আস্তে হাটতে হাটতে আসছে ।
আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । এসে বসলো ঠিক আমার পাশের সিটে । চারজনই কিছু সময় কোন কথা বললাম না । আসলে কেউ কোন কথা শুরু করতে পারছে না । কি বলবে, কিভাবে বলবে কেউ জানে না । সুচি আপুই সবার আগে কথা বলল । আমাদের ভেতরেই সেই মোটামুটি খানিকটা নির্ঝঞ্জাট। অথচ সব ঝামেলা তাকে নিয়েই বেঁধেছে ।
-তো তৃষা, তোমার কি খবর ?
তৃষা খুব আস্তে করেই বলল,
-ভাল ।
তৃষার কন্ঠস্বর আমি এই প্রথম শুনলাম । ঐদিন একটাবারের জন্যও আমি শুনতে পাই নি ।
ভাইয়া বলল,
-দেখ আমি আজকে তোমাকে, মানে তোমাদের ডেকেছি সরি বলার জন্য !
সকল আকাম করে আমাদের ঝামেলায় ফেলে এখন সরি । তুই যদি আমার থেকে ছোট হতি তাহলে আজকে তোর খবর ছিল !
তারপর দুজন মিলে আমাদেরকে আরও অনেক কথা বলল তাদের কিভাবে পরিচয় হয়েছে আর কিভাবে সব কিছু হল । আমরা দুজন বলতে গেলে চুপ করেই শুনে গেলাম । কোন কথার ভেতরে গেলাম না । যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম তখন প্রায় ১০ টা বেজে গেছে । ভাইয়া বলল তৃষাকে হলে রেখে আসতে । না বললেও আমি ওর সাথে যেতাম এমনিতেও ।
তিন
এর আগেও আমি রিক্সা করে রাতেরবেলায় এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি এবং পাশে একটা মেয়ে তখনও ছিল কিন্তু আজকে কেন জানি অন্য রকম লাগছে । লাগার কথা নয় আবার হয়তো কথাও । তৃষা অবশ্য কোন কথা বলছে না । অন্যদিকে তাকিয়ে আছে । ওভাবে থেকেই বলল,
-তোমার আসার দরকার ছিল না ।
-হুম । জানি । দরকার ছিল না ।
-চাইলে এখনও নেমে যেতে পারো ।
-নাহ ! রিক্সাওয়ালা কি ভাববে বল ? ভাববে ঠিক করলো দুজন বলে এখন যাচ্ছে একজন ।
কিছু সময় তৃষা কোন কথা বলল না । এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুমি কি আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছো ?
-তোমার কেন এমনটা মনে হচ্ছে শুনি ?
তৃষ আবারও অন্য দিকে তাকালো । আমি বললাম,
-আচ্ছা, আমি তোমাকে কেন ইম্প্রেস করতে যাবো বল ? ছেলেরা কোন মেয়েকে কেন ইম্প্রেস করে ? যাদেরকে সে পটাতে চায় কিংবা যাদের সাথে প্রেম করার একটা ইচ্ছে থাকে কিংবা বিয়ে করার ……সেখানে তুমি তো ……..
আমি কথাটা শেষ করলাম না । তার আগেই তৃষা আমার আবারও তাকালো । এবার ওর চোখে এমন কিছু ছিল যে আমি চুপ হয়ে গেলাম । ও এখনও দুর্ঘটনাটা ঠিকমত মেনে নিতে পারে নি । একটা মেয়ের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া একটু কষ্টেরই বটে । আমি আর কথা বাড়ালাম না ! বাকি পথটুকু চুপচাপ রইলাম ।
হলের সামনে গিয়ে তৃষা নামার আগে বলল,
-এতো কেয়ার দেখানোর দরকার নেই । তোমার আর আমার সম্পর্ক কোনদিন সহজ হবে না । তোমাদের পরিবারের সাথেও কোনদিন সহজ সম্পর্ক তৈরি করতে পারবো বলে আমার মনে হয় না ।
-আই আন্ডারস্ট্যান্ড !
-ইউ বেটার বি !
তৃষা রিক্সা থেকে নেমে গেল । গেটের কাছে যেতে ওর আরও দশ সেকেন্ডের মত সময় লাগার কথা । আমি তাকিয়ে রইলাম ওর চলে যাওয়ার দিকে । কেন জানি মনে হচ্ছিলো যে ও একবার হলেও ফিরে তাকাবে আমার দিকে । কিন্তু তাকালো না । কোন প্রকার পেছনে না তাকিয়েই ভেতরে চলে গেল । আমি রিক্সা ঘুরাতে বললাম । কেন জানি মন খারাপ শুরু হল আমার ।
আমি আগে থেকেই জানতাম যে তৃষার সাথে আমার কোনদিন সহজ একটা সম্পর্ক তৈরি হবে না । সেদিন যখন বাসর ঘরে ঢুকেছিলাম তখনই আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম যে তৃষা আমাকে মোটেই মেনে নিতে পারে নি । একটা মেয়ের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া অনেকটাই কষ্টের । আমি নিজেও কি সেরকম অবস্থায় ছিলাম সেদিন ! সারাটা রাত আমি বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিলাম । তখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আসলেই আমার সাথে যা হল তা সত্যিই হচ্ছে নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি । আমার তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না ।
ভাইয়া পালিয়ে যাওয়ার পরপর বাবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো । সবাই রাস্তার পাশে গাড়ি বহর দাড় করিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না । শেষে আর না পেরে বাবা তৃষার বাবাকে ফোন দিল । এখানে কি ঘটে গেছে সব জানালো । আমরা কোথায় আছি সেটাও বলল !
দেখলাম আধা ঘন্টার ভেতরেই মেয়ের বাপ এসে হাজির । আমার বাবার সাথে উচ্চস্বরে কি যেন কথা বলতে লাগলেন । আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারি নি আমার উপর কি বিপদ এসে পড়তে যাচ্ছে । আব্বার সাথে কথা বলতে বলতেই তৃষার আব্বা আমার দিকে তাকালেন ! তারপর আমার কাছে এসে বললেন,
-তুমি কোথায় পড় ?
বললাম কোথায় পড়ি !
-কোন ইয়ার ?
তখনই মনে হল এক ইয়ার কমিয়ে বলি । আমার কেন জানি তখনই সন্দেহ হয়ে গিয়েছিল । পরক্ষণেই উড়িয়ে দিলাম । ভাবলাম এমনটা কখনও হয় নাকি ! সত্যি বলে দিলাম । তিনি আবারও বাবার কাছে চলে গেলেন । বাবাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে কি যেন বলল । বাবাকে দেখলাম চমকে উঠতে । প্রথমে মাথা এদিক ওদিক করে মানা করার ভঙ্গি করলেও একসময় দেখলাম ঠিক ঠিক মেনে নিল । দুজনেই আমার কাছে যেটা বলল তা শুনার পরে মনে হল, আমারও ভাইয়ার সাথে সাথে পালানো দরকার ছিল । অন্তত এই ঝামেলায় পড়তে হত না ।
বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি মাত্রই পড়ালেখা করি, আমি কিভাবে এখন বিয়ে করতে পারি । বাবা বলল,
-সমস্যা কোথায় ? বউকে এখনই তোমাকে খাওয়াতে হবে না । সেটা আমি দেখবো !
-আব্বা খাওয়ার ব্যাপার না ?
-তাহলে ? বিয়ে তো করবাই । দু বছর আগে পরে ।
-কিন্তু আব্বা !
-কোন কিন্তু না । তোমার বড় ভাই কি করেছে দেখো নি ! তুমিও সেই পথে যাবে ? একটা কথা মনে রেখো আজকে যদি বউ ছাড়া আমাদের গাড়ি ফিরে যায় তাহলে আমি ভুলে যাব আমার কোন ছেলে আছে ।
এবার মেয়ের বাবা এগিয়ে এলেন । আমার বাবা তো আমার কঠিনভাবে ভয় দেখালো আর মেয়ের বাবা আমাকে ইমোশনালী ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলেন । দুজনের সামনে নিজেকে কেমন অসহায় মনে হল । বারবার ইচ্ছে হল ভাইয়ার মত আমিও পালিয়ে যাই । কিন্তু পালানোর পথ সব বন্ধ !
জীবন স্বাভাবিক হয়ে এল কিছুদিন পরেই । আমার যে বিয়ে হয়েছে এটা বন্ধুদের কাউকে বললাম না । মাঝে মাঝে তৃষার সাথে দেখা হয়ে যেত । কোনদিন আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে । ওর ডিপার্টমেন্টটা আমার ডিপার্টমেন্ট পার হয়েই তারপর যাওয়া লাগতো । তাই হয়তো দেখা হত মাঝে মাঝে । আমি দাঁড়িয়ে পড়তাম । আশা করতাম যে ও হয়তো দাঁড়াবো । ও দাঁড়াতো না ! তবে আগে যেমন মুখ কঠিন করে চলে যেত আস্তে আস্তে সেটা কমে এল । আমি হাসলে ও হাসতো না, দাঁড়াতোও না । চুপ করে চলে যেত !
আমি প্রায়ই যেতাম ওদের ডিপার্টমেন্টে । ওকে দেখতাম লুকিয়ে । কোন কোন দিন চোখাচোখী হয়ে যেত। আমি এমন একটা ভাব করতাম যে আমার কোন বন্ধুর খোঁজে এসেছি ।
কি একটা অদ্ভুত মায়া জন্মানো শুরু করলো মেয়েটার জন্য । মাঝে মাঝে মনে হত তৃষার এরকম কিছুই মনে হত না ?
যদি হয় তাহলে কেন প্রকাশ করতো না ?
নাকি ও তেমন কোন কিছু অনুভবই করতো না !
ভাইয়া কদিনের ভেতরেই বিয়ে করে ফেলল সুচি আপুকে । তবে সেই নিষেধাজ্ঞা তখনও বহালই রইলো । আমি আর তৃষা দুজনকেই যেতে বলেছিল । তৃষা যায় নি । তবে দ্বিতীয়বারের মত আমি ভাইয়ার বিয়েতে হাজির হলাম । এবার অবশ্য আমার আর ভয়ের কোন কারণ ছিল না !
তৃষা খুব একটা যোগাযোগ করতো না । আমি মাঝে মাঝে ফোন দিলে ও ফোন ধরতো । কথার জবাব দিতো এর বেশি কিছু না । আমার সত্যি সত্যিই মনে হল যে তৃষার সাথে আমার আসলেই কোন কিছু হবে না আর । বাদ দেওয়াই ভাল মনে হয় । কিন্তু মন চাইলো না । দুর্ঘটনা হলেও সে তো আমার বউই !
তবে একদিন ১১টার দিকে তৃষার ফোন এসে হাজির । আমার সেদিন ক্লাস ছিল না বলে আমি ক্যাম্পাসে যাই নি ! ফোন পেয়ে একটু অবাক হলাম বটে । একটু খুশিও ।
-হ্যা ! বল !
-তুমি কোথায় ? ক্যাম্পাসে আসো নি ?
-নাহ ! ক্লাস নাই তো আজকে ।
তৃষার কন্ঠ কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগলো । ও কি ভয় পেয়েছে কোন কারণে ? কোন সমস্যা হয়েছে !
আমি বললাম,
-কি হয়েছে ?
-না কিছু না !
-আমাকে বল কি হয়েছে ? বল আমাকে ? কী হয়েছে ?
চার
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র এক মিনিট পার হয়েছে অথচ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে আমি যেন অনন্তকাল ধরে এই বাসের ভেতরেই বসে আছি । আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম । এই অস্থিরতা নিয়ে বাসের ভেতরে বসে থাকা সম্ভব না ।
বাইরে তাকিয়ে দেখি গাড়ির লম্বা লাইন ।
আজকে কেন জানি এই জ্যামটা খুব বেশি অসহ্য মনে হল । অথচ এর আগে এরকম কোনদিন মনে হয় নি, বরং বলা চলে আমি সব সময় জ্যামটা এনজয় করেছি । আজকে তৃষা জড়িত এই জন্য ?
আমার বারবারই মনে হচ্ছে এখন আমার তৃষার পাশে থাকা উচিৎ । ওর উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর শোনার পর থেকে নিজের ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতা বোধ করছি । শুভকে ফোন দিয়ে শুনলাম ক্যাম্পাসে নাকি আসলেই ঝামেলা শুরু হয়েছে । অনেকেই নাকি ক্যাম্পাসে আটকা পড়েছে ।
আমি আরেকবার জ্যামের দিকে তাকালাম । নাহ, এই জ্যাম সহজে ছাড়বে না । আমি সামনে পা বাড়ালাম । আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো যে যেকোনভাবেই হোক আমাকে তৃষার কাছে পৌঁছাতেই হবে । কখন যে আমি দৌড়াতে শুরু করেছি আমি নিজেই জানি না ।
দৌড়ানোর সময়ই আমার কত কথা মনে হতে লাগলো তৃষাকে নিয়ে । যদিও একসাথে আমাদের খুব একটা স্মৃতি নেই তবুও ঘুরে ফিরে সেই কথাগুলো মনে হচ্ছে ।
সপ্তাহ খানেক আগের কথা । সকালবেলা ঘুমিয়ে ছিলাম তখনই একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির । রিসিভ করতেই বুঝতে পারলাম তৃষার বাবা । উনি ঢাকায় এসেছেন কাজে । আমার সাথে দেখা করতে চান । ঘুম-টুম ফেলে রেডি হয়ে গেলাম । ভেবেছিলাম তৃষা হয়তো আগে থেকেই সেখানে থাকবে কিন্তু উনি একাই ছিলেন ।
আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেলেন । প্রথম প্রথম একটু কেমন যেন লাগছিল পরে অবশ্য সেটা কেটে গেল । দুপুরের দিকে তৃষার হলের সামনে গিয়ে ওকে নিচে আসতে বললাম ।
তৃষা যখন নিচে আসলো তখন ওর বাবাকে দেখে একটু অবাক হল । বিশেষ করে ওর বাবা ঢাকায় এসে ওর আগে আমার কাছে গেছেন এটাই মনে হয় তৃষার বিস্ময়ের কারণ ছিল । এটা অবশ্য আমার নিজের কাছেও বিস্ময়ের কারণ ছিল ।
আসলে মেয়ের বাবাদের কাছে মনে হয় এমনিভাবেই তাদের মেয়ের জামাইয়েরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । তার আদরের মেয়েকে যে মানুষটা দেখে রাখবে সেই মানুষটা বাবাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক । প্রিয় থেকে একটা ভরশার স্থান তৈরি হয় । বাবারা কেবল এটাই ভাবে যে তার অবর্তমানে তার মেয়েকে এই ছেলেটা ঠিকঠিক দেখে রাখবে, মেয়ের বিপদে তাকে আগলে রাখবে, ঠিক যেমনটা এতোদিন বাবারা রেখেছিলেন ।
আমাদেরকে উনি এরপর বসুন্ধরা সিটিতে নিয়ে গেলেন । উনি আগে আগে হাটছিলেন, আমি আর তৃষা পেছন পেছন হাটছিলাম । আমাদের পেছনে রেখেই উনি নন স্টপ কথা বলেই যাচ্ছিলেন । আমরা দুজন কেবল চুপ করে শুনছিলাম । আমার কেন জানি ভালই লাগছিল । তৃষার মুখ দেখে অবশ্য কিছু বোঝা যাচ্ছিলো না । তৃষা মনে হয় একটু দ্বিধায় পরে গিয়েছিল যে ও কি করবে ! ওর বাবার সামনে আমার সাথে কিরকম ব্যবহার করা উচিৎ সেটা ও ঠিকমত বুঝতে পারছিলো না ।
খাওয়া দাওয়ার পরে তৃষার বাবা আমাদের দুজনের জন্য কেনাকটা করে দিলেন । মানা করা সত্ত্বেও শুনলেন না । আমারও কেন জানি মনে হল আমারো কিছু কিনে দেওয়া উচিৎ । বাড়ির জামাইয়েরা শ্বশুরের জন্য উপহার কিনে নিয়ে যায় । যদিও সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে । কিন্তু তবুও মনে হল কিছু কিনে দেওয়া উচিৎ । একটা পাঞ্জাবী দেখলাম কিন্তু সেটা কেনার মত টাকা পকেটে নেই ।
তৃষার কাছে চাইবো ?
একবার মনে হল দরকার নেই । আরেকটু কমের ভেতরে দেখি । পরে মনে হল দেখিই বলে ।
তৃষার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
-হাজারখানেক টাকা হবে তোমার কাছে ?
একটু বিস্ময় নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তৃষা বলল,
-কেন ?
-আব্বার জন্য একটা পাঞ্জাবী দেখেছি । আমি পকেটে এতো টাকা নিয়ে বের হই নি । তোমার কাছে থাকলে আপাতত ধার দাও । কাল ক্যাম্পাসে দিয়ে দেব ।
তৃষার মুখের ভাবটা একটু পরিবর্তিত হতে দেখলাম । তারপর ব্যাগ থেকে একটা নোট বের করে দিয়ে বলল,
-ফেরৎ দেওয়া লাগবে না !
আমি যখন তৃষার আব্বাকে নিয়ে পাঞ্জাবীর কাছে গেলাম, উনি তো কিছুতেই নেবেন না । বারবার বলতে লাগলেন যে তুমি মাত্র পড়াশুনা কর তুমি টাকা পাবে কোথায় ?
এক পর্যায়ে তৃষা আমাদের কাছে এসে বলল,
-আব্বু, নাও ও যখন দিতে চাচ্ছে !
তৃষার চেহারার দিকে তাকিয়ে কেন জানি অন্যরকম লাগলো । আনন্দময় অনুভুতি ! তৃষার আব্বা খুবই খুশি হলেন । সেই সাথে তৃষাও নিশ্চয়ই খুশী হয়েছে ।
আমি যখন ক্যাম্পাসে পৌঁছালাম তখন কেবলই মনে হচ্ছিলো আমি এখনই হার্ট ফেইল করে মারা যাবো । এর আগে এতো লম্বা সময় আমি একটানা দৌড়াই নাই কোনদিন । আধা মিনিট মুখ হা করে দম নিলাম কেবল । তারপর আবার দৌড়াতে শুরু করলাম ওর ডিপার্টমেন্টের দিকে । তখনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে গন্ডগোলের । ওদের ডিপার্মেন্টের সামনে অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল । আমাকে দেখেই আটকালো ।
-আপনি এখন ভেতরে যেতে পারবেন না !
-দেখুন, আমার স্ত্রী ভেতরে আছে । আমাকে ভেতরে যেতেই হবে !
-আপনার স্ত্রী !
-জি !
পুলিশ সাহবে কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো সরু চোখে । কথাটা ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিলো না তার ! অনেকেরই অবশ্য বিশ্বাস হবে না, হওয়ার কথাও না । পুলিশের পেছনে দিয়ে ডিপার্টমেন্টের গ্রিলের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে তৃষা এসে দাঁড়িয়ে আছে । আমি হাত দিয়ে তৃষাকে দেখালাম । পুলিশ ওকে দেখে কি যেন ভাবলো তারপর আমাকে ভেতরে যেতে দিল ! আমি যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম তখন তৃষা এসে বলল,
-তুমি এরকম হাপাচ্ছো কেন ?
আমি কোন কথা না বলে কেবল দম নিতে লাগলাম !
তৃষা আবার বলল,
-শাহবাগ থেকে দৌড়ে এসেছো ?
কিছু বললাম না । হা করে তখনও দমই নিচ্ছি ! কয়েক মুহূর্ত পরে তৃষার চোখে একটা বিস্ময় দেখতে পেলাম । ও অবাক হয়ে বলল,
-তুমি মোহাম্মাদপুর থেকে দৌড়ে এসেছো ?
নীচুস্বরে বললাম,
-জ্যাম ছিল রাস্তায় খুব !
তখনই আমি তৃষার চোখে কিছু একটা দেখলাম । কি দেখলাম আমি নিজেই জানি না ! ও আমাকে টেনে নিয়ে গেল একটা ক্লাসরুমের ভেতরে । ফ্যানের নিচে বসালো !
-এরকম পাগলামো কেউ করে ! যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটতো ?
-কি ঘটবে !
-আশ্চর্য ! মানুষ টানা এতো লম্বা সময় দৌড়াতে পারে অভ্যাস না থাকলে !
কপট রাগের চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । তবে এই রাগটা কেন জানি আমি ঠিক অন্য রাগের সাথে মেলাতে পারলাম না ! এই রাগের সংজ্ঞা ভিন্ন !
আরও ঘন্টাখানেক পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে ওকে নিয়ে বের হলাম । হলে পৌঁছে দিয়ে যখন রিক্সা নিয়ে রওনা দিয়েছি তখন যতবার পেছন ফিরে তাকালাম দেখি ও গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে । কেন জানি ভাল লাগলো । মনে হচ্ছিলো যে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে । ওর ভেতরেও, আমার নিজের ভেতরেও ।
সন্ধ্যার দিকে তৃষা আবার নিজেই আমাকে ফোন দিল ।
-একটা ঝামেলা হয়ে গেছে !
-কি ?
-ক্যাম্পাসের ঝামের জন্য কর্তৃপক্ষ হল ভ্যাকেন্ট করার নির্দেশ দিয়েছে । নয়টার ভেতরে !
-ও ! আচ্ছা ! সমস্যা নেই তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নাও । আমি তোমাকে বাসস্ট্যান্ডে দিয়ে আসতেছি । সমস্যা নেই ।
-এই রাতের বেলা !
-চাইলে আমি তোমার সাথে যেতে পারি !
-আমার পক্ষে এখন ঢাকা ছাড়া সম্ভব না ! তুমি জানো না আমি একটা টিউশনী করি !
-ও ! তাহলে ?
কি বলবো বুঝতে পারলাম না ! নিজের মনের ভেতরে একটা কথা বলার ইচ্ছে করছিলো কিন্তু বলতে সংকোচ হচ্ছিলো ! আমি বললাম,
-তোমার না একটা মামার বাসায় আছে কোথায় ? ওখানে দিয়ে আসবো ?
-ওখানে আমি যাই না !
-কোন বন্ধুর বাসা !
-না !
একবার মনে হল বলেই ফেলি ! তারপর মনে হল, না থাক দরকার নেই । কি না কি মনে করে বসবে ! এমনিতেই একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে এর ভেতরে আবার ঝামেলা বাধানোর দরকার নেই ! আরেকবার মনে হল না, একটাবার বলেই দেখা যাক না কি হয় !
আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,
-আমি এখানে একাই থাকি ! রুমটা যদিও একটু ছোট তবে দুজনের থাকতে কষ্ট হবে না ! আমার এখানে আসবা ?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর এল না ! আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
একবার মনে হল বলে কি ভুলই করলাম ! ও যদি আবার রেগে যায় !!
পাঁচ
কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিলো নিজের কাছেই যে তৃষা আসলেই আমার সাথে যাচ্ছে, একই রিক্সায় করে আমার বাসায় থাকার জন্য । হলের গেট দিয়ে যখন বেরিয়ে এল তখনও ওর দৃষ্টিটা নিচের দিকে ছিল । একটু যেন লজ্জা পাচ্ছিলো আমার সাথে যাওয়ার জন্য কিংবা অন্য কিছু হবে হয়তো । আমাকে দেখে একটু হাসলো । প্রতি উত্তরে আমিও হাসলাম । ব্যাগটা হাতে নিয়ে যখন রিক্সায় উঠলাম তৃষা প্রথমেই বলল,
-আব্বু ফোন দিয়েছিল ?
সন্ধ্যার দিকে শ্বশুরমশাই ফোন দিয়েছিলেন । আমি তখন কেবল বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি । তখই ফোনটা এসে হাজির ! আমি নাম্বারটা দেখেই তাড়াতাড়ি রিসিভ করে সালাম দিলাম ।
-শুনলাম ওদের নাকি হল ভ্যাকেন্টের নির্দেশ দিয়েছে ?
-জি !
-তুমি কি ওকে বাসায় রাখতে আসবে ?
-না মানে ও ঢাকা ছাড়তে চাইছে না । ওর নাকি কি কাজ আছে ঢাকায় !
-তাহলে ?
কয়েক মুহূর্ত কি বলবো ঠিক খুঁজে পেলাম না । একবার মনে হল বলি, আরেকবার মনে হল না বলি ! একটু যেন সংকোচও লাগছিল বলতে । তারপর ভাবলাম বলেই ফেলি ! বললাম,
-আসলে ও আমার এখানে আসতে চাইছে । আমি ওকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি ।
-ও ! আচ্ছা, আচ্ছা ! তাহলে তো সমস্যা নেই । তোমার সমস্যা হবে না তো ?
-না ! সমস্যা হবে কেন ! কি যে বলেন আপনি ? আপনি চিন্তা করবেন না !
-আরে আমার আর চিন্তা কি, তুমি আছো না ওর পাশে ।
তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বললেন,
-তুমি ওকে দেখাশুনা কর কেমন ? করবে না ?
-আমি তো আছি ! আপনি চিন্তা করবেন না ।
একটু বাতাস দিচ্ছিলো । আমি চুপ করেই বসে আছি রিক্সায় । তৃষার ব্যাগটা আমাদের পায়ের কাছে রাখা । আমি মনে মনে বাক্য সাজাচ্ছি তৃষাকে বলার জন্য কিন্তু কেন জানি বাক্যগুলো আর বলতে পারছি না । শেষে তৃষা নিজেই আগে কথা বলল,
-তোমার আসলেই সমস্যা হবে না তো ?
-আরে বাবা না রে ! সমস্যা কেন হবে ?
-ঠিক তো ? না মানে হুট করেই একজন ঘরের ভেতরে চলে আসাটা ……..
-তুমি তো সেই কবেই চলে এসেছো আমার জীবনে । হুট করেই অবশ্য, তবে এখন এটাই কি স্বাভাবিক না? বরং তুমি না থাকলেই ….
-না থাকলে কি ?
তৃষা তখনও আমার দিকে তাকায় নি । রাস্তায় দিকে তাকিয়ে আছে ।
-না থাকলে মনে হয় কি জানি নাই ।
এবার তৃষা আমার দিকে তাকালো ।
-কেন মনে হয় এমনটা ?
-আমি জানি না । ঐদিনের পর থেকেই এরকম মনে হয় । আমি জানি আমাদের শুরুটা ভালভাবে হয় নি, কিছুটৃ অন্যরকমভাবে হয়েছে । হয়তো আমাদের ভাগ্যেই এমনটা হওয়ার কথা ছিল । আমি আসলে …..
তৃষা চুপ করে থাকলো আরও কয়েক মুহূর্ত । তারপর বলল,
-ঐদিন রাতে তোমার সাথে ….. আসলে তোমার সাথে …… আসলে তোমার তো দোষ ছিল না । কিন্তু আমি ….
-ইউ মিন আমাদের বাসর রাত ?
-হুম !
বাসর !! কি অদ্ভুত একটা শব্দ ছিল আমার জন্য ।
কত কিছুই না ভাবতাম একটা সময় এই রাতের কথা ভেবে । কিন্তু সবকিছু কি ইচ্ছেমত হয় !
তৃষা আর কোন কথা না বলে চুপ করে রইলো । আমিও কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না ! কিংবা কি বলা উচিৎ । ঝিগাতলায় আসার পরেই হঠাৎই তৃষা বলল,
-এই, একটু দাঁড়াও তো !
তারপর রিক্সাওয়ালাকে বলল,
-এই মামা দাঁড়ান ! দাঁড়ান !
-কেন ?
তৃষা হাত বাড়িয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের পাশের ফুলের দোকানটা দেখালো ।
-কি ?
-আসো ।
এই বলে আমাকে টেনেই নিয়ে গেল ওখানে গেল ।
আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারছি না আসলে ও কি বলতে চাইছে । এতো রাতে ফুলের দোকান দিয়ে কি করবে ?
তৃষাকে অনেকগুলো গাঁদা ফুলের মালা কিনতে দেখলাম । আর বেশ কিছু গোলাপ ফুল । রাতেরবেলা বলেই হয়তো ফুলগুলো বেশ সস্তাতেই পাওয়া গেল ! হাত ভর্তি ফুল নিয়ে আমরা আবারো রিক্সায় উঠলাম । আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারছি না যে ঠিক কি কারণে তৃষা এতোগুলো ফুল কিনলো । অবশ্য আমি ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না । ওর যা ভাল লাগে করুক । আমার কেবল ওকে ভাল লাগছিল । ও যে আমার পাশে পাশে আমার কাছে যাচ্ছে এটার থেকে আনন্দের আর কিছু মনে হচ্ছিলো না ।
ছয়
যখন তৃষাকে নিয়ে আমার চিলেকোঠার ঘরে ঢুকলাম তখনও আমার ঠিকমত সবকিছু বিশ্বাস হচ্ছিলো না ! বিয়ের পর থেকে কতবার কল্পনা করেছি ওকে এখানে নিয়ে আসবো, এই ছোট্ট ঘরে আমার দুজনের জীবনটা একসাথে শুরু হবে । তারপর পড়ালেখা শেষ করে আমরা দুজনেই যখন চাকরী করবো তখন একটা বড় বাসা নিবো । এতোদিন সেটা কেবল কল্পনাই ছিল এমনকি আমি কোনদিন ভাবিই নি যে তৃষা কোনদিন আমার এই ঘরে আসবে !
তৃষা ঘরে ঢুকতেই কিছু সময় চারিদিকে তাকালো । আমি অবশ্য যাওয়ার আগেই যথেষ্ট পরিমাণে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম । কিন্তু কতটুকু হয়েছে কে জানে । তৃষা বলল,
-বাহ ! বেশ গোছালো তো তুমি !
-এই আর কি !
-ঘোড়ার ডিম ! আমি আসার আগে গুছিয়েছো তাই না ?
আমি হাসলাম । তৃষা ঠিক ঠিক বুঝে ফেলেছে । ফুলগুলো বিছানার উপরে রেখে বসলো বিছানার উপরেই । আমি ব্যাগটা নামিয়ে রেখে চেয়ারের উপর বসলাম । বললাম,
-পছন্দ হয়েতো ঘর ?
-বলা যায় !
-যাক, এখন আপাতত চললেই হবে । পরে দেখা যাবে ।
-শুনো রাতে কি খাবো ? রান্না হবে নাকি বাইরে থেকে ?
-তুমি যা বল । বাইরে থেকে চাইলে বাইরে থেকে, রান্না করতে চাইলে সেটারও ব্যবস্থা আছে !
-আজকে রান্নার সময় নেই । ঠিক আছে । অনেক কাজ বাকি আছে । তুমি বাইরে থেকে কিছু নিয়ে আসো ! আমি ততক্ষণে দেখি তোমার ঘরের কি করা যায় !
আমি বাইরে চলে গেলাম । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখন সবেমাত্র ১০ টার মত বাজে । তৃষা আরও কিছু জিনিস কিনতে দিলো আমার কাছে । যখন ফিরে আসলাম তখন আমার জন্য আসলেই অন্য কিছু একটা অপেক্ষা করছিল । তাকিয়ে দেখি এরই ভেতরে তৃষা অনেকটাই ঘরের চেহারাটা পাল্টে ফেলেছে । বিছানার চাদরটা পাল্টানো হয়েছে । সেই সাথে কিনে আনা ফুলগুলো দিয়ে এদিক ওদিকে সাজানো হয়েছে । এরই ভেতরে তৃষা এতো সব কিভাবে করলো ঠিক বুঝলাম না ।
আমাকে দেখে তৃষা বলল,
-কই ? মোমবাতি নিয়ে এসেছো ?
-হুম !
আমি মোমগুলো ওর হাতে দিলাম । ও সেগুলো নিয়ে বিছানার সামনের ঠিক সামনে রাখলো !
আমি ওকে বললাম,
-কি করছো ?
-কেন ? পছন্দ হচ্ছে না ?
-না মানে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-সেদিনের ভুলটা শুদ্ধ করার চেষ্টা করছি ! আমাদের বিয়ে তো হয়েছে ঠিকই কিন্তু একটা চমৎকার বাসররাত আসে নি । আই হোপ আজকে কিছুটা হলেও সেটা পূর্ণ হবে ।
-মানে ?
আমি কেবল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে । এই মেয়েটা একটু আগে কি বলল ?
বাসর ?
সত্যি !
তৃষা এবার আমার কাছে এল চলে । একেবারে কাছে । এতোদিনে এতো কাছে সে আসে নাই কখনও ।
-ঐদিন আব্বুর সাথে তোমাকে দেখে আমার কেন জানি অন্যরকম লাগলো ! আমার বাবা তোমাকে পেয়ে কেমন জানি নিশ্চিন্ত হয়ে তাকিয়েছিল । বিশেষ করে তুমি যখন আব্বুর জন্য পাঞ্জাবীটা কিনছিলে আব্বুর চোখে অদ্ভুত একটা আনন্দ দেখতে পেয়েছিলাম ! আমি ঠিক জানি না এটা আমি কিভাবে তোমাকে ব্যাখ্যা করবো । এতো ভাল লাগলো দৃশ্যটা দেখে । ঐদিনই তোমাকে কেন জানি পছন্দ হয়ে গেল খুব !
কিছুটা সময় নিরবতা ! তারপর তৃষা আবারও বলতে শুরু করলো,
-আমি তোমার সাথে শুরু থেকেই খারাপ ব্যবহার করেছি । কিন্তু বোঝার চেষ্টা করি নি যে যা হয়েছে তাতে তোমার কোন দোষ নেই । এতো খারাপ লাগা শুরু করলো নিজের কাছে । তারপর আজকে তোমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে আমার যত রাগ, যত অভিমান ছিল সবকিছু …… দুপুরেই ঐ তখনই তোমাকে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো !
-ওকেই !!
আমি আর কি বলবো ঠিক বুঝলাম না ! আর কি বলা উচিৎ তাও ঠিক বুঝতে পারলাম না !
তারপর তৃষা নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল । জিজ্ঞেস করলাম,
-কি এটা ?
-পাঞ্জাবী !
-আমার জন্য ?
কি গাধার মত প্রশ্ন ? আমার জন্যই অবশ্যই ।
-হুম ! বাসরঘর যখন হতে যাচ্ছে বরকে তো পাঞ্জাবী পরেই আসতে হবে । তাই না ?
-তাহলে বউ হয়ে যে বাসরঘরে অপেক্ষা করবে তাকেও বেনারসী পরতে হয় !
-হুম ! বাট আমারটা তো বাসায় । নিয়ে আসি নি !
আমি একটু হাসলাম কেবল । জানি না এটাকে ঠিক কাকতালীয় বলবো কি না কে জানে ! আমি কদিন আগেই ওর জন্য লাল রংয়ের একটা শাড়ি কিনেছিলাম । এমনিতেই কিনেছিলাম কিন্তু দেওয়ার সময় পাই নি । কিংবা দেওয়া হয়ে ওঠে নি ।
আমি শাড়িটা বের করে দিতেই তৃৃষা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ।
-কেবল শাড়ীই আছে অন্য কিছু কেনা হয় নি । যদিও এটা বেনারসী না । চলবে এতে ?
তৃষা আমার হাত থেকে শাড়িটা নিল । তারপর কি মনে হতেই এগিয়ল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলে । বেশ শক্ত করেই ।
ওর শরীরের কাঁপনটা আমি ঠিক ঠিক অনুভব করছিলাম । ও কি কাঁদছে ?
আচ্ছা আমার চোখেও কি পানি আসলো একটু ?
আনন্দের ?
কিংবা খুব প্রিয় কাউকে কাছে পাবার আনন্দ !!
পরিশিষ্ট
এতোদিনের পরিচিত ঘরটা হঠাৎ করেই কেমন অপরিচিত লাগছে আমার কাছে । ঘরের লাইট অফ করে দেওয়া হয়েছে । সেখানে একটা ডিম লাইট জ্বলছে । দুই পাশের দুই জানালা খোলা । যদিও এখন শীতকাল না তবে আসবে আসবে করছে । একটু ঠান্ডা বাতাস আসছে ঘরে । খাট থেকে একটু দূরে মেঝেতে বেশ কয়েকটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে । বাতাসে সেগুলো কাঁপছে আর পুরো ঘরের চেহারা ক্ষণে ক্ষণেই বদলাচ্ছে । মিউজিক প্লেয়ারে মৃদুস্বরে গান বাজছে । এক কথায় সব মিলিয়ে এর থেকে চমৎকার আর কিছু হতে পারে না ।
আমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই চোখ গেল বিছানার দিকে । আবছায়া আলোতেই তৃষাকে দেখলাম ঘোমটা মাথায় দিয়ে বসে আছে । বাসরঘরটা বলবো না আহামরি খুব সুন্দর হয়েছে কিন্তু দুজন মিলে ফুলগুলো দিয়ে যা পেরেছি তা যথেষ্ট এই রাতের জন্য । আমার কাছে কেবল মনে হল এর থেকে চমৎকার আসলেই এই রাতের বেলা আর কিছু হতে পারে না ।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম খাটের দিকে ।
একটু নার্ভাস ?
হয়তো ?
আনন্দময় দ্বিধা নিশ্চয়ই তৃষার ভেতরেও কাজ করছে । আমি খাটের উপর বসতেই তৃষা একটু নড়ে উঠলো । আস্তে করে ওর ঘোমটা টা উঠালাম উপরে ।
মোম আর ডিম লাইটের আলোতে তৃষার লজ্জামিশ্রিত চেহারা দেখে মনে হল এতোদিন ধরে যে দিনটার অপেক্ষা করছিলাম সেটা চলে এসেছে । একদম আমার সামনে এসে হাজির । আর কিছুরই হয়তো দরকার নেই ।
তৃষা একটু হাসলো । তারপর বলল,
-বউ পছন্দ হয়েছে তো ?
আমি কেবল তাকিয়েই রইলাম । প্রথমবার যখন আমি বাসরঘরে ঢুকেছিলাম তখন কি ভেবেছিলাম যে আমার জীবনে আসলেই এমন একটা দিন আবারও ঘুরে আসবে । সেদিন যে মেয়েটা আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে শুয়ে ছিল, সে আজকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভালবাসার চোখে, সামনের দিনগুলোর স্বপ্ন নিয়ে !
আমি তৃষার হাত ধরলাম । তারপর বললাম,
-আমাদের শুরুটা হয়তো ভালভাবে হয় নি কিন্তু শেষটা সবথেকে সুন্দর হবে । সুন্দর হবে এর মাঝের একসাথে পথ চলাটা ! আই ক্যান গ্যারান্টি !
তৃষা কেবলই হাসলো ! সেই হাসিই বলে দিচ্ছে যে আমার কথা তার বিশ্বাস হয়েছে । আসলেই আমাদের সামনের দিনগুলো সবথেকে সুন্দর হতে যাচ্ছে, যার সূচনা আজকে এখান থেকেই !!
সমাপ্ত
This is one of my favourite stories!