দররাম পিশাচ

opu tanvir
4.6
(55)

গভীর রাত । চারিদিকে একটা অশুভ আবহাওয়া বিরাজ করছে । বারবার মনে হচ্ছে যেন কোন কিছু ঘটতে চলেছে । কোন অশুভ কিছু । রসুলপুর বড় শ্মশানের ভেতরে মানুষ দিনের বেলাতেই আসতে ভয় পায় । একা একা আসার প্রশ্নই আসে না । মরা পোড়ানোর দরকার হলে সবার দল বেঁধে এসে দিনের আলো থাকতেই কাজ শেষ করে চলে যায় । রাতের বেলা এখানে কেউ আসতে সাহস পায় না ।

তবে আজকের কথা আলাদা । শ্মশানের ঠিক মাঝখানে, যেখানে মরা পোড়া হয় সেখানে একটা ছাউনির মত স্থান আছে । সেখানেই সেই দুইজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে । একজনের দুজন একে অন্যের কাছ থেকে তিন হাত দূরে বসে আছে । তারা বসে আছে একটা মৃত দেহের উপরে । মৃত দেহের নাভির উপরে একটা পিতলের হাড়ির ভেতরে আগুন জ্বলছে ।

মৃত দেহের মুখের কাছে যে লোকটা বসে আছে সে বিড়বিড় করে কিছু পড়ে চলেছে আর মাঝে মাঝেই জ্বলন্ত হাড়ির ভেতরে কিছু ছুড়ে দিচ্ছে । পায়ের উপরে বসে থাকা মানুষটা একভাবে আগুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । তার চোখে একটা তীব্র ঘৃণা আর রাগ দেখা যাচ্ছে ।

মুখের উপরে বসে থাকা লোকটা বলল, আরেকবার ভেবে দেখ।

অন্য মানুষটা বলল, আর কিছু ভাবাভাবি নেই ।

-একবার যদি দররাম জেগে ওঠে তাহলে কিন্তু আর ফেরানোর কোন উপায় নেই ।

-আমি তা চাইও না ।

অন্য লোকটা আর কোন কথা কথা বলল না । আবারও মন্ত্র জাতীয় কিছু পড়তে শুরু করলো ।

তখনই পায়ের কাছে বসে থাকা লোকটার মনে হল যেন লাশটা একটু যেন নড়ে উঠলো । সত্যিই কি ? নাকি মনের ভুল ! অবশ্য মনের ভুলই হয়তো হবে । লাশটা সে ওদের মর্গ থেকে কিনে নিয়ে এসেছে । যদিও একটু গোপনীয়তা বজায় রাখতে বেশ কিছু টাকা দিতে হয়েছে । তারপরেও কাজটা যে হচ্ছে এটাই সব থেকে বড় কথা । অনেক দিন পরে সে প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে । ওকে অপমান করার প্রতিশোধ ! এতো বড় সাহস মেয়েটার ! নিজেকে কী ভাবে সে ! আজকের পরে সে বুঝবে আসল মজা !

এক

সিমুর ঘরের সাথেই একটা লাগোয়া বারন্দায় রয়েছে । ঢাকা শহরের বারান্দা গুলো খুব বেশি বড় হয় না কোন কালেই । তার পরেও সিমুর মনে হয় যে এই ছোট্ট বারান্দাটা ওর মনের মত একটা জায়গা । এখানে কয়েকটা ফুলের টব রাখা রয়েছে । গ্রীলের সাথেও কয়েকটা টব রয়েছে । প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা গাছ গুলোতে পানি দিতে পছন্দ করে সে । আজকেও তাই করছিল । সন্ধ্যা হয়েছে একটু আগে । অল্প অল্প বাতাস দিচ্ছে । বারান্দায় বসে থাকতে ভাল লাগছে ওর । তবে আজকে সে বেশি সময় বসে থাকতে পারবে না । কালকে ভার্সিটিতে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা রয়েছে । রমিজ স্যারের ইনকোর্স । যদি ভাল নম্বর না পাওয়া যায় তাহলে স্যার খুব অপমান করবে। সবার সামনে খাতা তুলে ধরবে । এটা সে মোটেই চায় না ।

গাছে পানি দেওয়া প্রায় শেষ । সিমু মগটা হাতে নিয়ে শেষ টবে পানি দিতে শুরু করেছে এমন সময় ওর চোখ নিচের রাস্তায় উপরে গেল । ওদের ফ্ল্যাটটা তিন তলাতে । নিচের রাস্তাটা বেশ পরিস্কার ভাবে দেখা যায় । সিমুর ঘর থেকে যে রাস্তা টা দেখা যায় সেটা প্রধান সড়কের না । একটা গলির রাস্তায় । গলিতে খুব একটা ভীড় থাকে না সব সময় । আজকেও ছিল না ।

সিমুর চোখ গলিতে পড়তেই ওর বুকের ভেতর টা কেমন যে ধক করে উঠলো । একটা লোক তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । এক ভাবে । লোকটা গলির রাস্তার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে । সিমুর মনে হল হয়তো লোকটা পাগল হবে । কারণ লোকটার পরনে কোন পোশাক নেই । ঢাকা শহরে নগ্ন পাগল দেখাটা স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এই পাগল লোকটাকে অন্য রকম মনে হচ্ছে । সে এক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । সিমু যেন নড়তে ভুলে গেছে ।  একভাবে তাকিয়ে রয়েছে লোকটার দিকে । লোকটাও এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে সিমুর দিকে ।

এরপরই আরও একটা কান্ড ঘটলো । সিমু দেখলো লোকটা এক লাফ দিয়ে পাশের বাড়ির দেওয়ালের উপরে উঠে গেল । দেওয়ালে হাত দিয়ে আটকে রইলো । দৃশ্যটা সিমুর মনে আরও বেশি ভয় ধরিয়ে দিলো । স্পাইডারম্যান যেমন করে দেওয়ালে আটকে থাকে লোকটাও সেই রকম ভাবে দেওয়ালে আটকে রয়েছে । এরপরেই লোকটা আরও এক লাফে আরও এক তলাতে উঠে পড়ল । তারপর আরেকটা তলা । এভাবে সিমুদের বিল্ডিং বরাবর উপরে উঠে পড়ল । তারপর সেখান থেকে এক লাফে ঠিক সিমুর বারান্দার গ্রিলে এসে পড়লো । সিমু এবার বারান্দার দরজা দিয়ে ছিটকে পড়ল নিজের ঘরের মেঝেতে । আপনা আপনি চিৎকার বের হয়ে এল মুখ দিয়ে । লোকটা তখনও গ্রিলের ওপাশে ঝুলে রয়েছে । তাকিয়ে রয়েছে সিমুর দিকে ।

সিমুর চিৎকার শুনে সিমুর মা ঘরে ঢুকলেন । সিমুকে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে সে দৌড়ে এলেন সিমুর কাছে । বললেন, কী হয়েছে তোর ? এমন করছিস কেন?

সিমু তখন এতোই ভয় পেয়েছে যে কোণ কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারছিল না । কেবল হাত দিয়ে কোন মতে বারান্দার দরকার দিকে ইশারা করে দেখাল। সিমুর মা সেদিকে তাকিয়ে দেখলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না । তবে পুরো ঘর জুড়ে একটা বিদ্ঘুটে গন্ধ টের পেল । অনেক টা মাংস পঁচার একটা গন্ধ !

দুই

-দেখুন, আমাদের এখন ছেলের বিয়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই । ছিলো না । কেবল মাত্র নাদিমের ইচ্ছেতেই আমরা কথা বার্তা বলছিলাম কিন্তু আপনার মেয়ের যে এই পাগলামির রোগ আছে এটা জানলে আমি কোণ দিন রাজি হতাম না ! আপনারা দয়া করে আমাদের ক্ষমা করুন ।

এই বলে ওপাশ থেকে ফোনটা রেখে দেওয়া হল । আতাউর রহমান খানিকটা বিষণ্ণ মুখে বসে রইলেন সোফাতে । কদিনের যেন তার বয়স যেন বেড়ে গেছে অনেক বেশি । মাত্র মাস দুয়েকের ভেতরে সব কিছু এমন হয়ে যাবে সেটা তারা কেউ কোন দিন ভাবতেও পারেন নি । কী এমন হয়ে গেল ! কার অভিশাপ লাগলো তার ফুলের মত নিষ্পাপ মেয়েটার উপরে !

সিমুর প্রথম ভয় পাওয়া শুরু করে মাস দুয়েক আগে । বারবার বলে ঐ লোকটা আসছে ওকে মারতে অথচ তারা কেউ কাউকে দেখতে পারছে না । তবে একটা মাংস পঁচা গন্ধ ঠিকই তারা পায় । এটা কোথা থেকে আসে কেউ জানে না ।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা গুরুত্ব না দিলেও পরে বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা সমস্যা ঠিকই হয়েছে । একজন সাইক্রায়াটিসের সাথে যোগাযোগ করা হল । এই খবর টা প্রথমে তিনি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু কাজ হয় নি । প্রথমে ফ্লাটের সবাই তারপর আশে পাশের অনেকেই জেনে গেল । এবং খবর টা নাদিমদের বাসায় পৌছে গেল ।

নাদিমের সাথে সিমুর অনেক দিনের পরিচয় । একটা ভাল সম্পর্ক ছিল । পারিবারিক ভাবে বিয়ের কথা বার্তা চলছিল । সেটা একটু আগে বন্ধ হয়ে গেল । খবর টা তিনি মেয়েকে কিভাবে দিবেন সেটাই ভাবছেন তিনি ।

সিমুকে সামনে দিয়ে বের হতে দেখে আতাউওর রহমান বললেন, কোথায় যাচ্ছিল?

-বাবা এভাবে আর কত দিন বসে থাকবো ! ক্লাসে যাচ্ছি । এমনিতেও অনেক মিস গিয়েছে । আর না ।

-তাই বলে এই শরীর নিয়ে ?

-বাবা আমি ঠিক আছে । এই সব আমার মনের ভুল । আর কিছু না । আর দিনের বেলা আমার কিছু হয় না । রাতের আগেই ফিরে আসবো । টেনশন নিও না !

তবে রাতের আগে সিমু ফিরে আসতে পারলো না । আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । বাস থেকে নেমে প্রধান সড়ক থেকে ওদের বাসা মাত্র মিনিট পাঁচেকের রাস্তা । তবে মাঝে সেই নির্জন গলিটা পড়ে । সিমুর ভয়টা আবার ফিরে এল । সে এবার নিশ্চিত জানে যে লোক টাকে সে দেখতে পাবে । গলিতে ঢোকার আগে সে একটু সময় অপেক্ষা করতে লাগলো । কারো সাথে সে ঢুকতে চাচ্ছে । একা একা ঢুকতে চাচ্ছে না মোটেও । কিন্তু মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কাউকে দেখতে পেল না । কেউ এল না ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য । সিমু এবার বুকে সাহস নিয়ে গলির ভেতরে পা দিল । ভয় পাচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে যে সামনে আজকেও তাকে দেখতে পারে আর সে আজকে ওকে কিছু না কিছু করে ফেলবে । কয়েক কদম পা এগিয়েছে তখনই দেখতে পেল তাকে । গলিটা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে । অথচ একটু আগে যখন গলির বাইরে থেকে ভেতরে তাকিয়ে ছিল তখন দেখেছিল ভেতরে আলো জ্বলছে । কিন্তু এখন কোন আলো জ্বলছে না । সিমু বুকের ভেতরে দুরু দুরু ভয় নিয়ে এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে ।

লোকটা এগিয়ে আসছে । সিমু দাড়িয়েই রইলো । ইচ্ছে হল পেছনে পালিয়ে যায় কিন্তু পারলো না । ও পা যেন আটকে গেছে মাটির সাথে ।

কী করবে ও এখন ?

আজকেই কি ও মারা যাবে ?

-উহু ! তুমি আজকে মরবে না !

কথাটা কেউ পাশ থেকে বলল ! সিমু খানিকটা চমকে গেল । পাশে তাকিয়ে দেখলো ওর ঠিক পাশেই একজন এসে দাড়িয়েছে । তাকিয়ে আছে সামনের দিকে । ওর থেকে কয়েক বছর বড় হবে । কালো প্যান্ট আর কালো একটা শার্ট পরে আছে , এক পাশের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখতে পাচ্ছে ।

তখনই একটা অবাক করা ব্যাপার খেয়াল করলো । গলিতে আলো ফিরে এসেছে। তবে সেই লোকটা এখনও আছে । কিন্তু সে দাঁড়িয়ে পড়েছে । ওর দিকে এগিয়ে আসছিলো সেটা আর আসছে না । সিমু পাশে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটাও তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে । সিমু কোন মতে বলল, আপনিও দেখতে পাচ্ছেন । তাই না ?

-হুম ! পাচ্ছি ।

-তার মানে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না । ঐটা আসলেই আছে ।

-হ্যা আছে । আসো ।

-না না ওটা আমাকে নিয়ে যাবে ।

-ভয় নেই । আসো । আমার হাত ধর !

সিমু দেখলো ছেলেটা ওর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে । সিমু সেই হাত ধরলো । সাথে সাথে পুরোরে যেন একটা ধাক্কা গেল । কেন ধাক্কা খেল সেটা সে জানে না তবে পর মুহুর্তেই অনুভব ওর শরীর থেকে ভয় জিনিসটা একদম চলে গেছে । সে আস্তে আস্তে হাটতে শুর করলো । সেই সাথে দেখতে পেল সেই লোকটা আস্তে আস্তে যেন পিছিয়ে যাচ্ছে । একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে যেতে সে একেবারে অন্ধকারে হারিয়ে গেল ।

-চলে গেল?

-না যায় নি । তবে তোমার চোখের আড়ালে গিয়েছে । সুযোগ পেলে আবার আসবে !

হাটতে হাটতে ওরা সিমুদের এপার্টমেন্টের সামনে চলে এল । সিমু আলোতে ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকাল । কী মায়াময় একটা চেহারা ! কিন্তু এই চেহারার সাথে এই তীক্ষ্ণ চোখ কেমন যেন বেমানান । ছেলেটার চোখ এট তীব্র কেন ? মনে হয় যেন সব কিছু ভেদ করে যাচ্ছে তার দৃষ্টি !

-আপনি কে?

-আমাকে নাদিম পাঠিয়েছে ।

-নাদিম !

-হ্যা । তোমার এই অবস্থা দেখে বেচারা বেশ কষ্টে আছে ।

-ভেতরে আসুন ।

-হ্যা চল । তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলা দরকার আমার !

তিন

আতাউর রহমান কিছু সময় সামনে বসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো । মনে মনে বেশ বিরক্তবোধ করছেন তবে মেয়ের কারণে কিছু কিছু বলতে পারছে না । ছেলেটা খুব স্বাভাবিক ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার দিকে । এমন বেশ তীক্ষ্ণ চোখে । এই চোখের দৃষ্টিই তার ভাল লাগছে না ।

আতাউর রহমান বললেন, তার মানে বলতে চান আপনি ভুতের ওঝা ?

সামনে বসা মানুষটা নিজের নাম বলেছে রাফায়েল । কেবল রাফায়েল । অন্য কিছু না । এই দেশে এমন নাম হয় কিনা তার জানা নেই । এক টেনিস প্লেয়ারের নাম রাফায়েল তিনি জানেন । ফ্রান্সে রাফায়েল জেট বিমান রয়েছে । কিন্তু এই দেশে রাফায়েল নামটা বেশ অপ্রচলিত ।

রাফায়েল হাসলো একটু । তারপর বলল, বলতে পারেন । যাক আমি অতিপ্রাকৃত ব্যাপার গুলো নিয়ে চলি । এটা আমার কাজ । মাঝে মাঝে কেউ আমার কাছে সাহায্য চায় । তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করি । এই যা । নাদিম আমার পরিচিত একজন মানুষের পরিচিত । সে অনুরোধ করেছে । তাই এসেছি ।

-তো কি দেখলেন?

-সিমুর পেছনে যা রয়েছে সেটা কোণ স্বাভাবিক কিছু না ।

-ঠিক বুঝলাম না ।

-মানে হচ্ছে এই দুনিয়াতে মানুষের পাশাপাশি আরও অনেক এন্টিটি বসবাস করে । মাঝে মাঝে এই এন্টিটি গুলো কোন কোন মানুষের ক্ষতি কিংবা উপকার করে কিংবা মানুষ এবং তাদের চলাচল স্থান ইন্টারসেক করলে কিছু একটা ঝামেলা হয়, এসব স্বাভাবিক । কিন্তু সিমুর সাথে যা হচ্ছে তা স্বাভাবিক না । দররাম এইভাবে কারো পেছনে লাগতে পারে না । তাকে কেউ জাগিয়ে নিয়ে এসেছে এবং সিমুর সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছে । এটা কোন ভাবে ধ্বংশ করা সম্ভব না । সে সিমুকে নিয়ে যাবেই ।

-মানে?

-মানে হচ্ছে ওকে মেরে ফেলবেই । আস্তে আস্তে কষ্ট দিয়ে !

সিমু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সব । সে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল । তারপর বলল, কিন্তু ওটা আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে চলে গেল তো !

রাফায়েল সিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় পেয়েছে তবে সেটা সে কাটিয়ে উঠবে ।

-এখন কী করার ?

-আগে সেই বন্ডটা কে ধ্বংশ করতে হবে । তবেই দররাম আর সিমুর গন্ধ খুজে পাবে না ।

আতাউর রহমান বলল, আপনি কি বলছেন তার আগা মাথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না ।

রাফায়েল একটু দম নিল । তারপর বলল, সব টুকু আপনারা বুঝতে পারবেনও না । তবে যথাসম্ভব বুঝিয়ে বলি । তান্ত্রিকদের ব্যাপারে তো শুনেছেন । পিশাচ সিদ্ধ তান্ত্রিকেরা অনেক ধরনের কাজ করতে পারে । তারপর ভেতরে একটা একটা হচ্ছে এই দররাম পিশাচ । প্রথমে একটা লাশ জোগার করতে হয় । টাটকা । একদিনের কম সময়ের মৃত্যু হয়েছে এমন । এবার তারপর উপরে বসে, ঠিক পেটের কাছে একটা আগুন জ্বালিয়ে সেখানে টার্গেট মানে যার পেছনে দররামকে লেলিয়ে দিতে হবে তার যে কোন কিছু একটা জিনিস সেখানে ফেলতে হবে । এবং কিছুতে দিতে হবে সেই লাশের নাকের কাছে । ছোট বেলাতে বেতালের গল্প পড়েছেন না, সেই রকম ।

সিমু বলল, কিন্তু কোন তান্ত্রিক আমার কেন ক্ষতি করতে চাইবে?

-হয়তো তান্ত্রিক না । কেউ তান্ত্রিককে ঠিক করেছে । অবশ্য সেই ক্ষেত্রে আরো একটা ব্যাপার আছে । তান্ত্রিক জানে যে এই পিশাচকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে না । যদি কোন ভাবে কেউ বন্ড ছুটে যায় তাহলে সে আবার ফিরে আসবে । এবং তাকে নিয়ে যাবে সাথে করে । এই কারণে তান্ত্রিকেরা সাধারনত একই সাথে দুই জনের গন্ধ শুকিয়ে থাকে । অর্থ্যাৎ আগুনের ভেতরে প্রথমে সিমুর মাথার চুল কিংবা পরনের কাপড় দিয়েছে এরপর সেই মানুষটার জিনিস দেওয়া হয়েছে । এবং সেই মানুষটা এই তন্ত্রের সময়ে সেখানে উপস্থির ছিল ।

সিমু বলল, মানে আমি যদি বাঁচি তাহলে এই পিশাচ তার পেছনে যাবে ?

-হ্যা । এটাই নিয়ম । ব্লাক ম্যাজিক খুব ভয়ংকর জিনিস । এটার ফল কখনও ভাল হয় না । কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে চাইলেই কেউ তোমার পেছনে দররামকে লেলিয়ে দিতে পারবে না । তোমার জিনিস লাগবে । এখন আমাকে বল কে কে তোমার চুল কিংবা কাপড় সহজে নিতে পারে ! এমন কে আছে?

-এমন তো কেউ নেই !  কাকে সন্দেহ করবো?

তখনই কান্নার আওয়াজ শোনা গেল । সিমু দেখলো, ঘরের ভেতরে থেকে ওদের বুয়া বের হয়ে এসেছে ।

-আফা গো আমারে মাফ কইরা দেন । আমি পাপ করছি !

-কী হয়েছে ? কাঁদছ কেন?

-আফা আমি বুঝি নাই আফা ! আমারে মাফ কইরা দেন !

-কী হয়েছে বলবে তো !

বুয়া যা বলল তার সারমর্ম হল হল উপরের তলার ফ্ল্যাটের ওসমান গনি সাহেবের ছেলের রাজীব আহমেদ বুয়াকে কিছু টাকা দিয়েছিল যাতে বুয়া তাকে সিমুর মাথার কয়েকটা চুল এনে দেয় ! বুয়া কিছু না বুঝে তাই করেছে ।

আতাউর রহমান বললেন, ঐ বদমাইশটা কে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো । বেটার এতো বড় সাহস !

রাফায়েল বলল, এসব কোর্টে প্রমান করা যাবে না কোণ ভাবেই । কেস টিকবে না । ওদের সাথে আপনাদের কিসের শত্রুতা শুনি?

সিমু বলল, শত্রুতা আসলে কিছুই না । আমাকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল । পেশায় সে ডাক্তার । তাও আবার ক্যাডার । এই কারণে নিজের উপরে একটা দম্ভ কাজ করে । তার মতে তাকে কোনো মেয়ে মানা করতেই পারে না । সব মেয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য । আমি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাই । এতে তার আত্মসম্মানে লাগে । সে আমাকে বলে যে দেখে নেবে । কিন্তু এই ভাবে দেখবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নি ।

চার

পরদিন আতাউপর রহমান রাজিবদের বাসায় গিয়ে অনেক চিৎকার চেঁচামিচি করল । তারপর বলে এল যে যদি সিমুর কিছু হয় তাহলে সে নিজে রাজিবকে গুলি করে মারবে । এমন কি থানাতে জিডি পর্যন্ত করে এল ।

দুদিন সিমুর সাথে রাজীবের দেখা হল লিফটে । প্রায়ই দেখা হয় । রাজীবের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সিমু বলল, আপনি এতো নিচে নামবেন আশা করি নি ।

রাজীব কেবল একটু মুচকি হাসলো , শুনেছি তোমার বিয়ে নাকি ভেঙ্গে গেছে ।

-তা ভাঙ্গুক । সেটা নিয়ে ভাবি না । তবে আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবা শুরু করেন ! আপনি যে যাকে ঠিক করেছিলেন সে সম্ভবত আপনাকে পুরো তথ্য দেয় নি ।

-মানে?

-মানে হচ্ছে কোনো ভাবে যদি দররাম আমাকে খুজে না পায় কিংবা আমার গন্ধ হারিয়ে ফেলে তাহলে সেটা আপনার পেছনে আসা শুরু করবে !

সিমুর মুখে দররামের কথা শুনে রাজীব একটু চমকালো । তবে সেটা সামলে নিলো সাথে সাথেই । বলল, কী সব আজেবাজে বকছো ! মাথা তাহলে সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে ?

সিমু আর কিছু বলল না । লিফট নিচে চলে এসেছে । সিমু বের হয়ে গেল বটে কিন্তু রাজীব বের হ্ল না ।

সিমু সাথে আজকে নাদিমও রয়েছে । রাফায়েল খোজ বের করে ফেলেছে সব । নাদিম যে হাসপাতালে কাজ করে সেখান থেকেই লাশটা সংগ্রহ করেছিল সে । লাশ ঘরের গেটম্যানকে টাকা খাইয়ে এই তথ্য বের করা হয়েছে । সেই গেটম্যানই জানায় যে হাসপাতালাকের লাশ বাহী গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল লাশ পরিবহনে । সেই ড্রাইভারকে কিচুহ টাকা দিতেই সে বলে কোথায় লাশটা নামিয়ে দিয়েছিল সে ।

রসুলপুরে শ্মশানে যখন ওরা নামলো তখন রাত হয়ে গেছে । সিমু নাদিমের হাত ধরে হাটছে। ওর বেশ ভয় ভয় করছে । শ্মশানের মাঝখানে আসতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলো ওরা । একজন জটাধারী নগ্ন তান্ত্রিক বসে রয়েছে ঠিক চিতা সাজানোর স্থানে । একটু আগে সেখানে সম্ভবত কোন মরা পোড়ানো হয়েছে । এখনও বাসাতে তীব্র কটু গন্ধ আর বয়ে বেড়াচ্ছে । সেই সাথে একটু ধোয়া উড়ছে । সেখানে যে প্রচন্ড তাপ রয়েছে সেটা ওদের কারো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না কিন্তু তারপরেও লোকটা কী অবলীলায় বসে আছে সেখানে !

ওরা আরও একটু এগোতেই তান্ত্রিক চোখ মেলে তাকালো ওদের দিকে । রক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর রাগত স্বরে বলল, এখানে কেন এসেছিস ? চলে……

বাক্যটা শেষ করলো না তান্ত্রিক । তার চোখ পরেছে রাফায়েলের উপরে ।

সাথে সাথে সে নিজের আসন ছেড়ে উঠে পড়ল । তারপর পেছনে ঘুড়ে দৌড়াতে শুরু করলো।

সিমু কিংবা নাদিম কেউ এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না । কিন্তু তার পরে যা হল সেটার জন্য ওরা কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিল না । ওরা দেখলো রাফায়েল নিজেদের হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে দিলো । সাথে সাথেই তান্ত্রীক আটকে গেল । দূর থেকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন পেছন থেকে তার গলা চেপে ধরেছে । এরপর তাকে সেই গলা ধরে উপরে তুলে নিয়ে আসছে ।

অনেকটা ভাসতে ভাসতে তান্ত্রিক আবার ওদের সামনে এসে হাজির হ্ল । নিজের হাত দিয়ে সেই অদৃশ্য হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেই চলেছে ।

সামনে আসতেই তান্ত্রিক বলল, আমাকে ছেড়ে দে ! ভাল হবে না বলে দিচ্ছি । আমার কিছু হলে আমাদের গুরু কিন্তু তোকে ছাড়বে না !

রাফায়েল যেন খুব মজা পেল । তারপর বলল, তোদের কোন গুরু? বিশুধর ? শোন তোকে কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই । কিন্তু বাধ্য করিস না । এই মেয়েটার পেছনে তুই দররামকে লাগিয়েছিস । সেই হাড়িটা কোথায়?

-এখানে নেই । নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিস ?

-আচ্ছা । তাহলে চল সেই নদীতেই তোকে আজকে ডুবিয়ে মারি !

রাফায়েল নিজের হাত টা আরও একটু উপরে তুলল । সেই সাথে তান্ত্রিকও আরও একটু উপরে উঠে গেল !

-দাড়া দাড়া ! দেখাচ্ছি । আমাকে ছেড়ে দে আমি দেখাচ্ছি !

তান্ত্রীক মাটিতে আছড়ে পড়লো । উঠে গিয়ে হাত দশেক দূরে একটা অশ্বল কাছের নিচ মাটি খুড়লো সে । তারপর সেখান থেকে একটা ছোট্ট পিতলের ঘটি বের করে নিয়ে এল । ঘটিটা রাফায়েলের কাছে এগিয়ে দিল । রাফায়েল সেটা মুখটা খুলে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো । তারপর ভেতরের সব কিছু মাটিতে ফেলে দিল ।

সিমু আরেকটা অবাক হয়ে গেল রাফায়েল হাত থেকে একটা উজ্জ্বল আলো বের হয়ে এল । তারপর নিচে পরা জিনিস গুলোতে আগুন জ্বলে উঠলো ।

তান্ত্রিক বলল, যা চেয়েছিলি দিয়েছি । এবার চলে যা এখান থেকে ।

রাফায়েল বলল, ঐ ছেলেটার টা কই?

-ওটা আমার কাছে নেই । আমি কিছু করি নি । আমি এতো বোকা না । আমি জাগাই নি ওকে । আমি কেবল বলে দিয়েছি কী কী করতে হবে । সে তাই করেছে । নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে সে দররামকে জাগিয়েছে ।

রাফায়েল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । সে জানে এখন কোন ভাবেই রাজীবকে আর রক্ষা করা যাবে না । রক্ত দিয়ে যখন জাগিয়েছে তখন আর কিছুই করার নেই ।

গাড়িতে করে ফেরার পথে সিমু বলল, আপনি ওটা কিভাবে করলেন?

-কোন টা ?

-ঐ যে হাত দিয়ে যেভাবে তান্ত্রিককে শূন্যে তুলে ফেললেন । কিভাবে করলেন?

-আমি জানি না । কেবল পারি ।

-আর কী কী পারেন ? আকাশে উড়তে পারেন ?

-আকাশে ! হাহা হা হা ! না আকাশে উড়তে পারি না । আচ্ছা শুনো আমাকে এখানে নামিয়ে দাও ।

নাদিম বলল, এখানে? এখানে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না । আপনার বাসা পর্যন্ত অন্তত পৌছে দিই । মিশু যখন আপনার কথা বলেছি আমার বিশ্বাস হয় নি । কিন্তু এখন নিজের চোখে দেখে, না বিশ্বাস করে পারি নি ।

রাফায়েল বলল, ওরে সর্বনাশ । মিশু ! ওর সাথে দেখা করার কথা আজ বিকেলে । এখন বাজে কয়টা বাজে ! আজকে আমার খবর আছে ! জলদি গাড়ি থামাও । জলদি !

নাদিম গাড়ি থামালো । রাফায়েল গাড়ি থেকে নেমে ওদের দিকে একটা হাসি দিয়েই দ্রুত পাশের গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল । ওরা কেবল কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো । ঢাকায় পৌছাতে এখনও ওদের কম করে হলেও ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে । মিশুর কাছে এই লোক কিভাবে পৌছাবে কে জানে !

পরিশিষ্টঃ

রাজীবের নাইট ডিউটি শেষ ভোর ছয়টার সময় । এখনো তিন ঘন্টা বাকি । তিনটার দিকে এক কাপ কড়া ব্লাক কফি খেয়ে ঘুম তাড়িয়ে নেয় । আজও কফি মগ হাতে নিয়ে সে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাটছিল আস্তে আস্তে তখনই তার চোখ গেল করিডোরের একেবারে শেষ মাথার দিকে । সেখানে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে ।

রাজীব নিজেকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো । হয়তো কোন রোগীর গেস্ট । কিন্তু গেস্ট কেন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে । রাজীব দেখতে পেল লোকটা এক লাফে পাশের দেওয়া উঠে গেল । তারপর উল্টো দিকের দেওয়ালে আরেকটা ঝাপ দিলো । এইভাব এগিয়ে আসতে শুরু করলো ওর দিকে ! রাজীবের তখন লিফটে সিমুর কথা গুলো মনে পড়ে গেল । মুখ দিয়ে আপনা আপনি একটা তীব্র চিৎকার বের হয়ে এল তার !  

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 55

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →