এই সব মিথ্যা গল্প ৫

oputanvir
4.8
(72)

লাঞ্চ আওয়ার শেষ করে আবার যখন ডেস্ক ফিরে এলাম, দেখি নীরা আমার ডেস্কের সামনে দাড়িয়ে আছে । ওর চেহারায় এখনও রোদে পোড়া ভাবটা রয়ে গেছে । এটা যেতে আরও কয়েকটা দিন লাগবে । যেভাভে কয়েক দিন আমরা রোদের ভেতরে হেটেছি ওর চামড়া বেশ ভাল ভাবেই পুড়েছে । আমি এখনো বেশ অবাক হয়েছি যে নীরার মত একজন কির্সতং সামিট করতে পারবে । যদিও বেশ প্যারা সে আমাকে দিয়েছে । তারপরেও যে উঠতে পেরেছে সেটা বেশ বড় একটা ব্যাপার

আমাকে দেখে হাসলো নীরা । তারপর বলল, আজকে অফিসের পড়ে চলে যাবেন না যেন ! ওকে?
-কেন ? কোন কাজ আছে?
-হ্যা । আজকে আপনাকে ডিনার করাবো !
-হঠাৎ ?
-আপনার এটা পাও্না । আপনি না থাকলে ট্যুরে যে আমার কপালে কী হত কে জানে !

আমি হাসলাম । তারপর বললাম, এরকম প্রায়ই হয় । সো মেনশন নট !
-না না । না করবেন না প্লিজ । আজকে অফিসের পরে ডিনার আমার সাথে । ওকে?

আমার আর মানা করলাম না । নীরা হাসি মুখে চলে গেল । আমি নিজের ডেস্কে বসে কাজ করা শুরু করলাম ।

ভার্সিটি জীবন থেকেই আমার এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস । কর্ম ক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার পরেও ছুটি কিংবা শুক্রশনি মিলিয়ে প্রায়ই আমি এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়ি । নিজের ফেসবুকে সেই ছবি দেওয়ার পরে যখন পরদিন অফিসে আসি তখন কলিগরা অভিযোগের সুরে বলে যে আমি কেন তাদের কে আগে বলি নি । বললে তারাও আমার সাথে যেত । তাই এইবার যখন কির্সতং যাওয়ার সব কিছু ঠিক হল সবাইকে আগে থেকেই আমি বললাম যে সেখানে যাচ্ছি । সেই সাথে এও জানালাম যে ওখানে কী কী হবে কেমন কষ্ট হবে । প্রথমে সবাই খুব আগ্রহ দেখালো বটে কিন্তু নিজেরা যখন একটু রিসার্চ করলো তখন আর কেউ আগ্রহ দেখালো না । কিন্তু একজন রাজি হল যেতে । আমি সত্যিই খানিকটা অবাকই হলাম । তবে বুঝলাম যে নীরা যখন যাচ্ছে আমার জীবনটা প্যারাময় করে তুলবে ।

শেষ সময় পর্যন্ত আমার একটা ধারণা ছিল যে হয়তো নীরা যাবে না । তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ঠিক ঠিক ট্যুরে হাজির হয়ে গেল । এবং সত্যিই বলতে কী পুরো ট্যুরে আমার জীবনটা প্যারাময় করে তুলল । পুরো ট্যুর গ্রুপে আমাকেই সে চিনে এবং আমার সাথেই সে কাজ করে । সুতরাং আমার উপর তার অধিকার সব থেকে বেশি। পুরো ট্যুরে আমি এই জিনিসটা বুঝলাম যে নীরা খুব বেশি ডিমান্ডিং । ইফতি ভাই এটা করেন দেন ওটা এনে দেন, ভাইয়া ছবি তুলে দেন এভাবে তুলেন ওভাবে তুলেন, ভাইয়া প্লিজ একটু হেল্প করুন আরও কত কি যে !

তবে শেষ পর্যন্ত যে মেয়েটা উঠতে পারছে এটাই সব থেকে বড় কথা । পাহাড়ের চুড়ায় উঠে নীরা কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে । প্রতিবার পাহাড়ে উঠে আমিও এমন চোখে তাকিয়ে থাকি ।
তবে একটা ব্যাপার ঘটলো যে পুরো ট্রিপে নীরার সাথে আমার সম্পর্ক আরও ভাল হয়ে গেল । এতোদিন আমরা কেবল কলিগ ছিলাম এখন সম্ভবত কলিগের থেকে বেশি কিছু হয়ে গেলাম । বিশেষ করে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত নীরা টুকটুক করে আমার গল্প বলছিলো । ওর পরিবারের কথা বন্ধু বান্ধবের কথা জীবনে কী করেছে কী করেনি । পাহাড়ে যারা যায় ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন ঘর দেওয়া হয় না । পুরো গ্রুপটা একটা রুমের ভেতরেই থাকে । নীরা আমার পাশেই শুয়ে ছিল । প্রথমে ওর একটু অস্বস্থি লাগছিলো বুঝতে পারছিলাম । তবে সেটা কেটেও গিয়েছিলো ।

দুই
ডিনার টেবিলে খাবারের অর্ডার দিয়ে আমরা গল্প করতে লাগলাম । তখনই খেয়াল করলাম যে নীরাকে আজকে যেন একটু বেশি সুন্দর লাগছে । অফিসে কাজ করার সময়ও তো এতো সুন্দর লাগে নি ! সম্ভবত মেকাপ করে আলাদা ভাবে ।
এখানে ডিনার করার জন্য?
নাকি আমার জন্য?
চিন্তাটা আমি মাথা থেকে বের করে দিলাম । আমার জন্য মেকাপ করার কোন মানে নেই । মেয়েরা নিজেদের জন্য মেকাপ করে । নিজেদেরকে সুন্দর দেখানোর জন্য । এটাই স্বাভাবিক .। টুকটাক গল্প করতে করতে হঠাৎ নীরা বলল, ইফতি আপনাকে কয়েকটা কথা বলার জন্য আজকে এখানে নিয়ে এসেছি ।
-জ্বী বলুন ।
-আসলে ……।

নীরা কিছু সময় থামলো । কিছু যেন ভাবছে । তারপর নীরা বলল, আসলে কিভাবে যে বলি বুঝতে পারছি না ।
-এতো ভেবে লাভ নেই । মনে যা আছে বলে ফেলুন !
নীরা একটা লম্বা দম নিল । তারপর বলল, পুরো ট্যুরে আমাকে আপনার কেমন মনে হয়েছে ?
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না নীরার কথাটা । খানিকটা কৌতুলের চোখে তাকিয়ে রইলাম । নীরাও বুঝতে পারলো যে আমি ওর কথা ঠিক ধরতে পারি নি । নীরা বলল, মানে বলতে চাইছি যে আপনার মনে হয় নি যে আমি ডিমান্ডিং ! তাই না? অন্তত অফিসে আমি তো এমন না।

আমি একটু ভেবে বললাম, এটা সত্যিই । আপনি অফিসে এমন নন । তবে ওখানে একটু ডিমান্ডিং ছিলে।

নীরা হাসলো আবারও । তারপর বলল, সত্যিই বলতে কি আমি এমনটা ইচ্ছে করেই করেছি । মানে ইচ্ছে করে আপনাকে জ্বালিয়েছি ।
আমি সত্যিই অবাক হলাম । বিশেষ করে নীরা যখন ব্যাপারটা স্বীকার করে নিলো দেখে । বললাম, কেন জানতে পারি কি?
নীরা বলল, হ্যা এটার জন্যই আপনার সাথে আজকে কথা বলতে এসেছি ।

নীরা একটু দম নিল । তারপর বলল, আপনি তো জানেনই যে আমার বাবা নেই । আমি যখন কলেজে পড়ি তখন মারা গেছেন ।
-হ্যা আমি জানি ।
নীরার মুখটা একটু মলিন দেখলাম । তবে সেটা সে সামলে নিল । তাররপ আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার বাবার কাছে প্রিন্সেস ছিলাম । আমার যত চাহিদা সব কিছু সব সময় সে সবার আগে পূরণ করতো । একবার কী হয়েছিলো রাত তখন একটা । আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি । আমি বায়না ধরলাম যে আইসক্রিম খাবো । আম্মু তো এক ধমকে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। তবে বাবা ঠিক সেই রাত একটা সময়েই বাইরে বের হল । আইসক্রিম নিয়ে এল । এমন করে আমার সব চাহিদা সব সময় সে পূরণ করেছে ,

এই বলে নীরা একটু থামলো । তারপর আবার বলল, বাবা মারা যাওয়ার পরে হঠাৎ আবিস্কার করলাম যে আমার জেদ রাগ চাহিদার দাম আর কারো কাছে নেই । এমন কি আমার মায়ের কাছেও না । আমি বলছি না যে আমার মা আমাকে ভালোবাসে না । কিন্তু আমার বাবার মত করে না । আস্তে আস্তে তাই নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলাম । বুঝে গেলাম যে আমাকে আমার বাবার মত করে কেউ কেয়ার করবে না । জানেনই তো মেয়েদের জীবনের প্রথম প্রেম হয় তার বাবা । সব মেয়ের তার প্রেমিকের ভেতরে তার বাবার ছায়া দেখতে পছন্দ করবে যে তাকে প্রটেক্ট করবে, দেখে শুনে রাখবে । পরে আমি আরও একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তার কাছেও আসলে আমার চাহিদার খুব বেশি মূল্য ছিল না । এরপর আর সেদিকে যাই নি কোন দিন । নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি ।

আমার আসলে কী যে বলা উচিৎ আমি নিজেই জানি না । আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম নীরার দিকে । ওর চোখ দুটো কেমন যেন টলটল করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে । এই চাহনী অবশ্যই যে কোন ছেলের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ।

নীরা আবার বলতে শুরু করলো, অফিসে আপনি আসার পর থেকে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে ।
এই বলে নীরা হাসলো । লজ্জা মিশ্রিত হাসি । তারপর আবার বলল, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম কথাটা । তবে পছন্দ হলেও মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলাম । কারণটা আপনি নিশ্চিত ভাবেই বুঝতে পারছেন । কিন্তু দিন যতই যেতে লাগলো ততই মনে হল একটা কিছু না করে এভাবেই যদি বসে থাকি আমরা তাহলে তো কোন দিন আমি কাউকে কাছে পাবো না । একাই থাকতে হবে । তাই এই ব্যাপারটা দেখার জন্যই আপনার সাথে আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম । এবং আবিস্কার করলাম যে আপনি ঠিক ঠিক আমার জন্য কেয়ার করছেন । এই যে সব কিছু সহ্য করছেন ।

আমি জানতাম এমন কিছু হতে চলেছে । নীরা বলল, সো, এখন থেকে তোমাকে ঠিক ঠিক প্যারা দিবো আমি । বারবার দিবো । তুমি যতই দুরে যেতে চাও পালিয়ে যেতে চাও আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না ! বুঝেছো !

আমার চেহারার অবস্থা দেখেই নীরা শব্দ করে হেসে ফেলল । তারপর বলল, ভয় পেও না তো ! আমি ভাল মেয়ে ! মাঝে মধ্যে কেবল একটু আধটু ডিমান্ডিং ! আর কিছু না !

তারপর?
তারপর আর কি ! বাংলার প্রেমিকদের কপালে যা হয়ে থাকে আমার কপালেও তাই শুরু হল । সে গল্প অন্য কোন দিন !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 72

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →